পুজোর ভোগ।
শিউলিগন্ধি সকালে এখন ঘুম ভাঙে আগে। গ্রামের বাড়ির পুজোর জোগাড়ে পাড়াপড়শি জুটে যায়। কেউ পদ্মপাতায় মুড়ে আনেন বাগানের ফুল, কেউ নতুন ধানের খই-মুড়কি। নাড়ু তৈরির নারকেলও জোগান দেন পাড়াপড়শিই। সবই সাজিয়ে দেওয়া হয় দশভুজার সামনে।
বর্ষা শেষে শরতের নরম রোদ মৃন্ময়ী মূর্তির পায়ের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে নাটমন্দিরে। ও দিকে ভাঁড়ারের সিন্দুকের ধুলো ঝেড়ে একে-একে বার করা হল পুষ্পথালা, বারকোশ, লোহার কড়াই, ডাবু হাতা, চন্দ্রপুলির ছাঁচ... আরও কত কী! মহালয়ার পর থেকেই পুজোর ভোগের গোছগাছ।
আগে থেকে নারকেল কুরিয়ে তৈরি করে রাখা হয় নাড়ু। অনেক বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টি তৈরি হয়। পুজোর ভোগ রান্না শুরু কিন্তু শেষ পাত থেকে। মিষ্টি, নাড়ু, চন্দ্রপুলি, ঝুরো বোঁদে আগে থেকে তৈরি করে রাখা হয়। নারকেল কোরানোর জন্য ঠাকুরদালানে লাইন দিয়ে বসে যান কাকিমা-জেঠিমারা। আর এক জন থাকেন হেঁশেলে, গুড়ে পাক দিয়ে নারকেলের ছেই তৈরি হলেই তা বেতের চুবড়ি করে চলে আসবে নাটমন্দিরে। সেখানে চলবে নাড়ু পাকানো। নাড়ুর গন্ধে বাড়ির কচিকাঁচারাও তখন ঘুরঘুর করে হেঁশেলের চার পাশে। ছোঁচা বেড়ালটাও বসে থাকে। তাই নাড়ু পাকানো, হুলোটাকে তাড়ানো বা হাতআড়ানির কাজ জুটিয়ে দেওয়া হয় খুদেদেরও। তারাও আশায় থাকে, দিনের শেষে দুটো নাড়ু জুটে যাবে।
ইদানীং পুজোর জাঁক বেড়েছে। আগে ঘরোয়া আনাজপাতি, ফলপাকুড় আর পুকুরের মাছ দিয়েই আয়োজন হত পুজোর ভোগের। পুজোর জাঁকজমক বাড়ে ব্রিটিশ আমলে। কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসার সুবাদে বিত্তশালী হয়ে ওঠে কিছু পরিবার। সামাজিক প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হিসাবে তারা দুর্গাপুজো শুরু করে। জমিদারবাড়িকে কেন্দ্র করেই পুজোর অনুষ্ঠানের সূচনা। পরে তা বারোয়ারি পুজোর রূপ নেয়। তবে জমিদারবাড়ি হোক বা বারোয়ারি পুজো, ভোগের আয়োজন বিস্তৃত। কারণ সব পুজোতেই কম করে শ’খানেক লোকের পাত পড়বে। তার আয়োজন কম না।
এত লোকের ক্ষুধা নিবারণের জন্যই মনে হয় পুজোর ভোগে খিচুড়ির অগ্রাধিকার। চালে-ডালে ঘেঁটে, নতুন ফসলের ক’টি আনাজ ফেলে দিলেই হয়ে যায়। ভোগও নিবেদন করা হল, আবার হাজারটা মানুষের পেটও ভরল। গ্রামের বাড়িতে দিন ধরে চাল-ডালের হিসাব হত। সপ্তমীর দিন সাত কুনকে করে চাল-ডাল, অষ্টমীর দিন সেটা হয়ে যাবে আট কুনকে, আর নবমীতে ন’কুনকে। ভাজাও পাল্টে যেত— সপ্তমীতে সাত রকম, অষ্টমীতে আট রকম... এ ভাবে।
ঠাকুমা ছিলেন কাঁঠালপাড়া জমিদারবাড়ির মেয়ে। আম্মার মুখে শোনা, পুজোয় সময়ে বাড়ির আমবাগানে এক মানুষ সমান চৌবাচ্চা খোঁড়া হত। সেই চৌবাচ্চা ঢাকা পড়ত কলাপাতায়। সেই চৌবাচ্চা বারবেলার আগেই ভর্তি হয়ে যেত খিচুড়িতে। মায়ের ভোগ হয়ে গেলে সেই ভোগের খিচুড়ি মিশিয়ে দেওয়া হত বড় চৌবাচ্চার খিচুড়িতে। আশেপাশের চার-পাঁচ গ্রামের মানুষ আসত কোলে-কাঁখে বাচ্চা নিয়ে। সকলে যাতে পেট পুরে খেতে পারে, তাই এ ব্যবস্থা। অবাক কাণ্ড, সেই চৌবাচ্চা খোলা আমবাগানে তৈরি হলেও একটি পাতাও উড়ে এসে পড়ত না তার মধ্যে। আবার পাড়াতুতো এক দিদাকে দেখেছি, গরম খিচুড়ি নামিয়ে তাতে মিশিয়ে দিতেন লেবুপাতা। শালপাতায় সেই লেবুপাতার গন্ধে মোড়া খিচুড়ির স্বাদ খুলত চাকা-চাকা করে কাটা মোটা আলু ভাজার সঙ্গতে।
খিচুড়ির পাশাপাশি ঘি-ভাতও দেওয়া হত ভোগে। বাড়িতে তৈরি ঘিয়ে চাল মেখে দুধে ফুটিয়ে কাজু-কিশমিশ ছড়িয়ে তৈরি হত মিষ্টি ঘি-ভাত। সঙ্গে লম্বা বোঁটাওয়ালা বেগুন ভাজা, চাকা চাকা করে আলু ভাজা। সঙ্গতে বেগুন বাসন্তী, এঁচড় কোফতা, আলু-ফুলকপির রসা, কচুর লতি, পালং-বড়ির তরকারি, ছোলা দিয়ে লাউঘণ্ট, নারকেল কোরা দিয়ে মোচার ঘণ্ট, আরও কত কী... আমিষের চল ছিল না গ্রামের বাড়ির ভোগে। তবে পরে কলকাতায় বাড়ির পুজোয় ভেটকি, ইলিশ, চিংড়ির স্বাদ মিলেছে। সন্ধিপুজোয় মালশা ভোগ আর ল্যাটা মাছ পোড়াও হয় অনেক বাড়িতে।
গ্রামের পুজোয় যাওয়া হয় না বহু বছর। কিন্তু ভোগের ইচ্ছে থাকলে দেখেছি, ভোগও জুটে যায়। এ বিষয়ে পাড়ার ষাটোর্ধ্ব পিন্টেদার কথা মনে পড়ে। আট থেকে আশি সকলের পিন্টেদা বারোমাস ভোগ খেয়ে বেড়াতেন। অবিবাহিত পিন্টেদার বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট ছিল না। সারা বছরই মন্দির, পুজোর বাড়ির ভোগ জুটে যেত তাঁর। সাদা ধপধপে পাঞ্জাবি পরে সেজেগুজে এসে আসনপিঁড়ি হয়ে বসতেন। আর কেউ যদি বলতেন, “পিন্টেদা এ বার রান্না শিখুন। এ ভাবে কদ্দিন চলবে?” পিন্টেদা স্মিতমুখে, খানিকটা খিচুড়ি আর আলুভাজা মুখে পুরে বলতেন, “তোমাদের আছে ভক্তিযোগ, আর আমার হল গিয়ে ভোগযোগ!বুঝলে না!”