অঞ্চলের নাম উস্তি। রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ-এ উল্লেখ আছে; প্রাচীন বসত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার পথে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে চলে গিয়েছে পথ উস্তিতে পৌঁছনোর।
উন্নয়নের শতেক প্রকল্পের মধ্যে যে সব অঞ্চল পড়ে আছে পিছনে, সেই রকম সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এক পল্লি। সেখানে প্রাক্বিদ্যালয় শিক্ষাকেন্দ্র তিন থেকে পাঁচ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সের শিশুদের ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে শিক্ষার জগতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। দু’টি ভাগে— তিন থেকে সাড়ে চার আর সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ। ছ’বছর বয়সে এদের বর্ণ পরিচয় থেকে প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য তৈরি করে দেওয়া। বড় ইস্কুলে পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা যদি থাকে, তার প্রস্তুতি; লটারির ব্যবস্থা হলেও ভর্তি হয়ে যেন পাঠ গ্রহণ করতে পারে, তারও প্রস্তুতি।
পড়ুয়া জুটেই গেল। প্রতি ক্লাসে পনেরো জন, মানে মোট ত্রিশ জনের বেশি নেওয়া গেল না, স্থান সঙ্কুলানের সমস্যায়। শিক্ষিকা উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেই চলত, পাওয়া গেল অনার্স গ্র্যাজুয়েট মেয়ে। সহায়িকার কাজেও মহিলা— সবাই স্থানীয়। তাঁরা মাথায় ঘোমটা টেনে কাজ করেন পরম মমতা ও আগ্রহে। শিশুদের পরিচ্ছন্নতা শেখানো থেকে লেখাপড়া— সবই দেখতে হয়। গত পাঁচ বছর ধরে শিশুরা এখান থেকে অনায়াসে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক স্কুলে।
পাঠ্যক্রম তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন প্রথায়— শিক্ষিকাদের প্রক্রিয়ায় শরিক করে তুলে, তাঁদের পরামর্শ দিয়ে। সিমেস্টার ভাগ করে, প্রতি সিমেস্টারকে তিন মাস করে ভাগ করে, প্রতি ট্রাইমেস্টারের জন্য পরামর্শ— ‘কী পড়াবেন, কী ভাবে পড়াবেন, কী বই ব্যবহার করবেন’। সে সব বইপত্র ইস্কুলে দেওয়া আছে। ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেলে বদলে দেওয়া। স্থানীয় সচ্ছল পরিবারের এক তরুণ, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, এই প্রয়াসে পরম আগ্রহী। স্বতঃপ্রণোদিত এই তরুণ শিক্ষিকাদের বুঝিয়ে দেন পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য; অনেক সময় উপস্থিত থাকেন অবজ়ারভার-এর ভূমিকায়।
এই প্রয়াসে গ্রামের মানুষ আহ্লাদিত। তাঁদের অনুরোধ, “আপনারা ১৫টি শিশু নিয়ে আর একটি সেকশন খুলুন, খরচ গ্রাম থেকে চাঁদা তুলে সংগ্রহ করে দেব।” এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি তো আর হয় না।
‘মানবসম্পদ’ শব্দটির বহুল ব্যবহার। এ সম্পদ সঞ্চিত রয়েছে গ্রামেগঞ্জে, প্রান্তিক এলাকায়। যা ছিল অ-ব্যবহৃত, তাকে খুঁজে পেয়ে গড়ে তোলা গিয়েছে। স্থানীয় সম্পদে স্থানীয় উৎসাহে চলছে ইস্কুলের আগে ইস্কুল। এ এক প্রবেশিকা প্রক্রিয়া, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের যা একান্ত প্রয়োজন।
কোভিড অতিমারির প্রকোপে ইস্কুল বন্ধ। দুর্বলতর গোষ্ঠীর পড়ুয়ারা স্কুলছুট হয়ে যাবে— এ আশঙ্কা সর্বত্র। উস্তির এই পড়ুয়া শিশুরা স্কুলছুট হয়নি, হারিয়ে যায়নি। শিক্ষিকা দু’জন তাদের বাড়িতে গিয়ে কাজ দিয়ে আসেন, নিয়ে আসেন। অবশ্যই কোভিড সতর্কতা মেনে। এ বারের শিক্ষক দিবসে কিছু খুদে পড়ুয়া এসেছিল, দূরত্ব মেনে খোলা জায়গায় হাজির হয়ে ছড়া শুনিয়েছে, গান গেয়েছে, শিক্ষিকাদের হাতে তুলে দিয়েছে ফুল আর কলম। শিশুদের দেওয়া হয়েছে উপহারের প্যাকেট। যারা আসতে পারেনি, তাদের বাড়িতে ওই প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
অতিমারি পার হয়ে যখন স্কুল খোলা যাবে, তখন স্বভাবতই দেখা যাবে যে, দুর্বল পড়ুয়ারা অনেক কিছু ভুলে গিয়েছে। বৈভবের পাঠশালার বাইরে অনলাইন শিক্ষার সুযোগে বঞ্চিত এই শিশুরা প্রায় দুটো ক্লাস নেমে গিয়েছে। এদের তুলে আনা স্কুলগুলোর নিজ চেষ্টায় পেরে ওঠা কঠিন।
এখানে সমাজের এগিয়ে আসার দরকার হবে। সরকারি সাহায্য আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু সরকার তো পড়িয়ে দিতে পারে না। সমাজসেবী সংস্থাগুলি নিজ অঞ্চলের স্কুলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রেমিডিয়াল ক্লাস চালু করে দিলে এ কাজ সহজ হবে। যাঁরা উস্তিতে খুদে স্কুলে চালাচ্ছেন, তাঁদের রয়েছে এই পরিকল্পনা। যদি করা যায়।
টিকে থাকা, ঘুরে দাঁড়ানো— এ তো দায়বদ্ধতা। নিজের প্রতি, চার পাশের প্রতি। শিশির বিন্দুগুলো ভুলে না যাওয়া। ঘাসের শীর্ষ ক’টিকে বাঁচিয়ে রাখা।