আক্রান্ত: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার দাবিতে মিছিল, ঢাকা, ১১ অগস্ট। ছবি: পিটিআই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটা মনে পড়ছে, ‘অন্ধতা নেশনতন্ত্রেরই মূলগত ব্যাধি। মিথ্যা দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজেদের কাছে নিজেকে বড়ো করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজ্মের প্রধান অবলম্বন।’ (‘বিরোধমূলক আদর্শ’)
যুগদর্শী রবীন্দ্রনাথ নিজেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কেন এক দিন তিনি প্রায় ব্রাত্য হয়ে যাবেন আজকের বাংলাদেশে, বঙ্গ-তালিবানদের খাতায় চিহ্নিত হবেন পাক্কা ইসলাম-বিরোধী হিসাবে। গত অগস্টে তথাকথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর, এক ধরনের ডিজিটাল মিথ্যার অন্ধত্ব বাংলাদেশের স্মার্টফোন-পুষ্ট যুব প্রজন্মকেও নিঃশব্দে গ্রাস করে চলেছে। ভারতকে খাটো দেখানোর তাগিদ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সমাজমাধ্যম জুড়ে ভাইরাল শুধু বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সামনে, ভারতের জাতীয় পতাকার আদলে আঁকা একটি নকশা, যাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া আসা করছে সে দেশের ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মীরা। এই ঘটনার অনুপ্রেরণায় ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে আরও কিছু এ রকম রিলস, যার একটিতে দেখা যাচ্ছে একই কাজ করছে একেবারে প্রাথমিক বিভাগের শিশুরা তাদের স্কুলে। এই অপকাণ্ডগুলো ঘটিয়ে বা এগুলো ছড়িয়ে পরম পরিতোষ যাঁরা অনুভব করছেন, তাঁরা ভুলে গিয়েছেন যে এতে আসলে ভারতের কোনও সরকার বা রাজনৈতিক কোনও দলকে নয়, অপমান করা হয় ১৪০ কোটি ভারতীয়কে যাঁদের মধ্যে অন্তত ৩-৪ কোটি আত্মীয়স্বজন রয়েছেন বাংলাদেশিদেরও। সেই অপমানিত জনগণের মধ্যে আমরাও অন্তর্ভুক্ত, যারা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের সবাই এক রকম নয়, সবাই ধর্মান্ধ, মৌলবাদী কিংবা ভারতবিরোধী নয়।
তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে এপারেও। যে কাঁটাতারের নিষেধকে অনায়াসে উপেক্ষা করে এক দিন চলত গানে, কবিতায় গলাগলি করে হাঁটা, সেই কাঁটাতারের উপর দিয়ে শুরু হয়েছে নেটযুদ্ধ, আদান-প্রদান চলছে বিমূর্ত, ডিজিটাল ঘৃণার। কলকাতা এবং আরও কিছু শহরের ডাক্তাররা জানিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা কোনও রোগীর চিকিৎসা তাঁরা করবেন না। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চেয়ে, বাংলাদেশে জাতিপ্রেমের নামে, ইসলামের নামে সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধদের সদাশঙ্কিত রাখার যে প্রয়াস অন্তত নেটদুনিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমে ভেসে উঠছে, তা যথেষ্ট আশঙ্কার। এই আশঙ্কা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তো বটেই, এমনকি ঘনিয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ, অসম বা ত্রিপুরার স্থানীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতেও। এর কারণটা সহজবোধ্য। সাম্প্রদায়িক শকুনেরা, সে যে দেশেরই হোক না কেন, লাশের প্রতীক্ষায় থাকে সর্বদাই।
রাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তে জনতাকে অর্ধসত্য আর কাঁচা মিথ্যের ককটেল গিলিয়ে বিভ্রান্ত করাটা এখনকার মতো সহজ ইতিহাসে কখনও হয়নি। স্মার্টফোনের বোতাম টিপে হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আহরিত জ্ঞান আরও রং চড়িয়ে, রিলস বা স্টোরি বানিয়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের নিউজ়ফিডের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় কয়েক মিনিটেই। রং চড়ানোয়, হাতের কাছেই রয়েছে কৃত্রিম মেধাপুষ্ট রকমারি অ্যাপ। এ বছরের মাঝামাঝি থেকে সমাজমাধ্যমে এ রকম ভ্রান্ত তথ্যের সুনামি দেখছে বাংলাদেশ। গত জুলাই-অগস্টে, কখনও শোনা গেছে বাংলাদেশ ভারতে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইনগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, তো কখনও সমাজমাধ্যমে নকল ভিডিয়ো সহকারে পরিবেশিত হয়েছে কী ভাবে ভারত বাঁধের জল ছেড়ে ডুবিয়েছে নোয়াখালি, ফেনি বা কুমিল্লার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। কোথাও হিন্দু মন্দিরে কী ভাবে মাইক বাজিয়ে কোরানের নিন্দা করা হয়েছে তার ভুয়ো খতিয়ান মিলেছে।
তথ্যানুসন্ধান বা সত্যান্বেষণ হয়েছে বইকি, কারণ কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তো এমনকি নাৎসি জার্মানদের মধ্যেও ছিলেন। কিন্তু ফ্যাক্টচেকিং সব সময়েই ঘটে খানিকটা পরে, সেই অবকাশটুকু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের হোয়াটসঅ্যাপের খবর পড়ে, খেপে উঠে পাড়ারই একটি নিরীহ সংখ্যালঘু পরিবারকে ঘিরে ধরে পুড়িয়ে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট।
সাম্প্রতিক যে ঘটনাটিকে ঘিরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন করে উত্তাল হয়ে উঠেছে, সেই ইসকনের সন্ন্যাসী ও বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারি নিয়েও অসত্য ও অর্ধসত্যের বহুবর্ণী খেলা চলছে নেটনাগরিকদের মধ্যে। ইতিমধ্যে জেলবন্দি চিন্ময়কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে কোনও পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার হয়েছেন আর এক ব্রহ্মচারী শ্যামদাস প্রভু। ইসকন একটি স্বতন্ত্র সংগঠন এবং তাদের কার্যক্রমের জন্য তারা কোনও ভাবেই ভারতের মুখাপেক্ষী নয়। সারা বিশ্বে তাদের ৮০০টিরও বেশি মন্দির রয়েছে এবং মূলত ভক্তদের (যাঁদের অনেকেই ধনকুবের) দানেই তাদের কার্যক্রম চলে। সেই ইসকনকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রায় বি-টিম বানিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের তথাকথিত সমন্বয়কদের সমাজমাধ্যম-নির্ভর প্রোপাগান্ডা। এর সঙ্গে অবধারিত ভাবে বাজার গরম রাখছে এক এক রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। শেখ হাসিনাই আগে অভিযোগ তুলেছিলেন, বঙ্গোপসাগরের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দখলের আমেরিকান অপপ্রয়াস বিষয়ে। তার সূত্র ধরে সে দেশের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাঙ্গোপাঙ্গদের ঢাকায় অবস্থানের সঙ্গে চিন্ময় প্রভুর গ্রেফতারির সূক্ষ্ম যোগ এবং চিনের দাদাগিরি, অনেক কিছুই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু অপরিবর্তনীয় সত্যিটা হচ্ছে বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত তিন মাসে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে কট্টরপন্থীরা।
নতুন পরিস্থিতিতে হিন্দু বাঙালিদের নিশানা করার কারণটি অনেকটাই রাজনৈতিক। বাংলাদেশে হিন্দুদের ভোট সাধারণত আওয়ামী লীগের ঝুলিতে আসে। অনেকটা একই ভাবে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিও বিজেপির থেকে কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দলকে ভোট দিতে চান। বাংলাদেশের সখ্যালঘুরা একই কারণে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে বা বিএনপিকে ভোট দেন না, বিশেষত তাঁরা, যাঁদের মনে এখনও দগদগে থেকে গেছে ১৯৭০-৭১’এর সেই অপারেশন সার্চলাইট, খানসেনাদের সংঘটিত গণহত্যা ও ধর্ষণের নির্মম স্মৃতি। আবার এটাও ঠিক যে, আওয়ামী লীগের শাসনকালটি হিন্দুদের জন্য সব সময় স্বস্তিদায়ক ছিল না, ২০২১-এর দুর্গাপুজোর সময় কুমিল্লা ও সংলগ্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা মনে থাকবে সকলেরই। মনে করিয়ে দিই, ওই নিদারুণ সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের পিছনে ছিল কিন্তু পবিত্র কোরান অবমাননার একটি উস্কানিমূলক ও ভ্রান্ত ফেসবুক লাইভ।
এই ধরনের যে কোনও ডিজিটাল বিভ্রান্তি ভারতের মাটিতেও সংখ্যালঘুদের বিপন্ন করে। সুতরাং ব্যক্তিগত স্তরে সমাজমাধ্যমে যা-ই পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সেগুলোকে ছড়িয়ে না দিয়ে, আর একটু কষ্ট করে, আরও কয়েকটা সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করে নেওয়াটা এখন আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। এই ধরনের ঘটনা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতিতে আঘাত হানে না, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময়েও ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়েছিল। এর ফলে দেশের জন্য বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, পর্যটন এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পথ ধরে, বিরাট ঢক্কানিনাদ সহযোগে যে দেশ সদ্য এক বড় পরিবর্তন দেখল, আওয়ামী লীগপন্থী সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি অত্যল্প সময়ে বর্বরোচিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে, দেশব্যাপী অস্থিরতা ও অনিরাপত্তা সৃষ্টি করে সে দেশের পালাবদলের নায়করা ঠিক কী পেলেন? এই অবাধ বিশ্বায়নের যুগে, নিজেদের অর্থনৈতিক বনিয়াদ মজবুত করতে অনাগ্রহী থেকে, কেন তাঁরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বার্তা দিতে এত আগ্রহী হয়ে পড়লেন? ভারতের তথাকথিত দাদাগিরিরই যদি প্রতিবাদ করতে হয়, তা কি উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সহযোগে সারা দুনিয়ার সামনে মাথা উঁচু রেখে করে কাজ করলে হত না? তবে কি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়বদ্ধতা আসলে অর্পিত ছিল কিছু মৌলবাদী সংগঠনের উপর? মির মুগ্ধ-র মতো স্বপ্নালু চোখের তরুণদের শহিদত্ব কি আসলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আর একটি আফগানিস্তান বানানোর পরিকল্পনারই ফল?
উত্তরহীন এই প্রশ্নগুলোই আজ তাড়া করে বেড়াচ্ছে উপমহাদেশকে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা