ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি সুইডেনের ষোলো বছর বয়সী ছাত্রী গ্রেটা থুনবার্গ তামাম বিশ্বকে চমকে দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, ‘‘আমরা একটা ব্যাপক ধংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আর আপনারা টাকাপয়সা এবং সুন্দর আর্থিক বৃদ্ধির কথা বলছেন, আপনাদের কী সাহস!” গ্রেটা বলেছেন, ‘‘পৃথিবীকে বাচাঁতে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নাও। বিজ্ঞানীদের কথা শোনো।’’
রাষ্ট্রপ্রধানেরা তো বটেই, আমরা, সাধারণ মানুষও শুনেছি, পড়েছি আইপিসিসি-র (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে, যে ভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে পৃথিবীর আয়ু আর মাত্র বারো বছর। শুনেছি, তবে বিচলিত হইনি একটুও। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর পরিবেশ সংক্রান্ত যে সব সতর্কবার্তা দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছেন তা যদি সত্যিই আমাদের বিচলিত করত তবে আমাদের নির্বাচনগুলোতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সেটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু হত।
আমরা কেউ ভাবিনি, যে উন্নয়নের মোহে ভোট দিচ্ছি, সে উন্নয়ন কে ভোগ করবে, যদি পৃথিবীটাই বসবাসের উপযোগী না থাকে! আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য রঙিন ভবিষ্যৎ কল্পনা করে দিন-রাত তাদের সেই স্বপ্নের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। অথচ এক বারও ভাবছি না, তারা কোন পৃথিবীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি অফিসার হবে যে পৃথিবীটার আয়ু সাকুল্যে এক যুগ! ভয় পাচ্ছি, আমার সন্তানও কোনও দিন বলে উঠবে, ‘‘তোমরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। যে পৃথিবীটা আমাদের কাছ থেকে তোমরা ঋণ হিসাবে পেয়েছিলে সেটাকে তোমরা ধ্বংস করেছ।’’
রাষ্ট্রপ্রধানদের কথা শোনাতে হলে চাই বিশ্বব্যাপী আন্দোলন। যা গড়ে তুলতে গ্রেটার নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীরা ডেকেছিল ‘জলবায়ু’ ধর্মঘট। সে আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক। আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পথে নেমেছে। আমাদের কি কিছু করণীয় নেই? বেশিরভাগ মানুষ হয়তো বলবেন, ‘‘দু’মুঠো অন্নের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটছি, এ সব ভাবার সময় কোথায়?’’
ঠিক কথা, তবে বাড়িতে আগুন লাগলে পরে নেভাব বলে কাজে বেরনো চলে না, এটা তো মানবেন। আসুন, আমরা ভেবে দেখি আমাদের অন্ন-চিন্তার সঙ্গে পরিবেশ চিন্তাকে একটু হলেও মেশানো যায় কি না। বিন্দু বিন্দু জলে যেমন সিন্ধু হয়, তেমনি বিন্দু বিন্দু কার্বন-ডাই অক্সাইড জমে জমে বাতাসেও কার্বন-সিন্ধু তৈরি হয়েছে। শিল্প, কল-কারখানা যেমন রোজ বাতাসে যোগ করে লক্ষ কোটি বিন্দু কার্বন ডাই অক্সাইড, তেমনি আমাদের গৃহস্থালির কর্মকাণ্ডে আমরা প্রত্যেকে শত শত বিন্দু যোগ করি। সেখান থেকে যদি একটুখানি কমাতে পারি তাতে তো পৃথিবীর আয়ু কয়েকটি দিন
বাড়তে পারে।
এখন পুজোর মরসুম চলছে। ধূপ পুড়ছে, যজ্ঞ হচ্ছে, বাজি পুড়ছে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারি পৃথিবীকে বাঁচাতে বাজি পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। কালীপুজোয় এক দিনই হবে আলোকসজ্জা। এক সপ্তাহ নয়। কারণ কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করতে উৎপন্ন হয় প্রচুর
কার্বনডাই অক্সাইড।
আপনারা বলবেন, বা রে! বছরে ক’টা দিন আনন্দ করব না? কিন্তু অসময়ে মৃত্যুর পথে হাঁটা কী করে আনন্দ হতে পারে? যে যুগে ইলেকট্রিক আলো, মোটর গাড়ি, রেডিয়ো, টিভি, সিনেমা, মোবাইল কিচ্ছু ছিল না সে যুগে মানুষ আরও সুখে, আনন্দে জীবন যাপন করত। নিরাপদ, নির্মল আনন্দ আমরা আবিষ্কার করে নেব তখনই যখন দূষিত আনন্দকে নাগালের বাইরে দূর করে দেব। শুধু ছেলেমেয়েদের বোঝালে হবে না, নিজেদেরও কিছু ছাড়তে হবে। পুজোপাঠ, বিয়ে, উৎসবের ধরন বদলাতে হবে।
সারা পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষেরই উপাসনার উপাচার মোমবাতি, ধূপকাঠি। একটা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শুধু একটি গির্জায় বছরে এক লক্ষ পয়ঁত্রিশ হাজার মোমবাতি আর এক কেজি ধূপকাঠি পুড়েছে। সারা পৃথিবীতে তা হলে পরিমাণটা কী বিপুল হতে পারে অনুমান করা খুব কঠিন নয়। মোমবাতির দহনে উৎপন্ন গ্যাস ডিজেল ইঞ্জিনের ধোঁয়ার মতোই ক্ষতিকর। কারণ যে প্যারাফিন দিয়ে মোমবাতি তৈরি হয় সেটাও পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য। তাই গাড়ির ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় যে সব ক্ষতিকর গ্যাস থাকে (যেমন বেঞ্জিন, ফরম্যালডিহাইড, অ্যাক্রোলিন, সূক্ষ্ম বস্তুকণা) সে সবই থাকে মোম পোড়া ধোঁয়াতেও। এর প্রত্যেকটি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
সব বাড়িতে, মন্দিরে, চার্চে, কোথাও ধূপকাঠি বাদ দিয়ে উপাসনা হয় না। এমনকি দোকান-বাজারেও সে পোড়ার জন্য মজুত থাকে। আসুন দেখি, আমাদের সেই প্রিয় ধূপকাঠিরা যাদের ছাড়া সকালের পুজো, সন্ধ্যার সন্ধ্যাবাতি কিছুই সম্পূর্ণ হয় না, তারা আমাদের কী কী বিষ দিয়ে পুড়তে থাকে। ভারত, চিন, জাপানের মতো দেশে উৎপন্ন ধূপকাঠি নিয়ে গবেষণার রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ধূপকাঠি থেকে বেরিয়ে আসে প্রচুর সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গলায় ঢুকে শ্বাসনালীর কোষে জমা হয়। এ ছাড়াও থাকে প্রচুর উদ্বায়ী পদার্থ (VOC)। যার মধ্যে আছে CO2, CO, NO, ফরম্যালডিহাইড, বেঞ্জিন, টলুইন ইত্যাদি। স্বাস্থ্যের উপর যাদের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা গবেষণায় উঠে আসছে।
নিয়মিত এই ধোঁয়া শরীরে গেলে এর থেকে হতে পারে ১) গলার বা শ্বাসনালীর ক্যানসার, COPD, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা। ২) এ ছাড়া রক্তনালী ফুলে যায়। ফলে রক্ত চলাচল কমে গিয়ে হৃদরোগ হয়। ৩)রক্তে CO,NO বেড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলোর উপর প্রভাব ফেলে তৈরি করে স্নায়ুরোগ। আমরা সাধারণত ছোট্ট ঠাকুরঘরে, ছোট ফ্ল্যাটের ঘরে পাখা বন্ধ করে বা শীতকালে জানলা বন্ধ করে ধূপ জ্বালি। এতে বায়ু চলাচল কম হয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই জ্বালানোর পরে জানলা খুলে দিয়ে ফ্যান চালিয়ে দেওয়া উচিত।
এ ছাড়া আমরা প্রতি দিন পুজো বা সন্ধে দেওয়া হয়ে গেলে প্রদীপ, মোম বা ধূপকাঠি নিভিয়ে দিতে পারি। খেয়াল রাখতে পারি, দিনে যাতে একটার বেশি মোমবাতি বা ধূপকাঠি না জ্বলে। প্রদীপে শুধুমাত্র পুজোর সময়টুকু জ্বলার মতো অল্প তেল দিতে পারি। তা হলে CO2 নিঃসরণ ও অন্য ক্ষতি কমবে। আমরা যদি ধীরে ধীরে শুধু ফুল দিয়ে পুজো অভ্যাস করে নিই, তা হলে কি ঈশ্বর রুষ্ট হবেন? মনে হয় না। প্রকৃতিই তো ঈশ্বর। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, উত্তাপে জ্বলে ধ্বংসের হাত থেকে যদি তাঁর সন্তানেরা তাঁকে বাঁচাতে চায় তিনি আমাদের আশীর্বাদই করবেন।
প্রধান শিক্ষিকা, বহরমপুর লিপিকা মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল
তথ্য সূত্র— ১) Survey and emission of chemical substances from incense - The Danish Environmental Protection Agency.
২) Incense Sticks: A potential Source of Indoor Air Pollution – Shweta Rana.