পৃথিবীর ইতিহাস দু’ভাগে বিভক্ত হবে— করোনা-পূর্ব এবং করোনা-উত্তর। কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে দৈনন্দিনতায় কত পরিবর্তন আসবে, ইয়ত্তা নেই! হয়তো করমর্দন উঠে যাবে। হয়তো নমস্কার-বিনিময় হবে। থাকবে ‘দ্য উহান শেক’! পায়ে পায়ে অভিবাদন।
হয়তো পরিবর্তন আসবে না কিছু ক্ষেত্রে। আমরা আগের মতোই মাটিকে অযত্ন করব। জলকে মলিন করব। বায়ুকে ধূসরিত করব। অরণ্য আক্রমণ করব। তেল-কয়লা পুড়িয়ে চালিয়ে যাব ‘অগ্রগতি’র চাকা।
‘পুরুলিয়া’ নামে একটি সনেট লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘হে পুরুল্যে’ সম্বোধন-খ্যাত সনেটটির শেষ দু’টি চরণ— ‘বাড়ুক সৌভাগ্য তব এ প্রার্থনা করি/ ভাসুক সভ্যতা-স্রোতে নিত্য তব তরি’। ইতিহাস সাক্ষী, সভ্যতা-স্রোতই জনপদগুলিকে তার আদি মূল থেকে ছিন্ন করেছে। এর মাশুল দিতে হচ্ছে কতটা, করোনাভাইরাস আমাদের ঘাড় ধরে সেই হিসেব কষতে বসাল।
অথচ একটা বিরাট সময় কিন্তু মানবসভ্যতা এমন ছিল না। প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে নিহিত ইঙ্গিত জানায়, সেই যুগের মানুষ সব কিছুর কেন্দ্রেই পরিবেশকে রাখতেন। উপনিষদ তো জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত। সেখানেও অনেক শ্লোকে এই জল-মাটি-আকাশ-বায়ুর সঙ্গে জীবনের নিভৃত সংযোগের গান শুনি। তৈত্তিরীয় উপনিষদের একটি শ্লোকের মর্মার্থ: এই আত্মা হতে আকাশ উৎপন্ন হল, আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল, জল হতে পৃথিবী, পৃথিবী হতে ওষধিসমূহ, ওষধিসকল হতে অন্ন এবং অন্ন হতে পুরুষ (মানব অর্থে)। এখানে এই চাকাটির বর্ণনায় ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমের সঙ্গে মানবজীবনের যোগাযোগটাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হল। সেটা যে উপেক্ষণীয় নয়, এই শিক্ষাটা নিহিত রইল। মুণ্ডকোপনিষদের ‘তস্মাদগ্নিঃ সমিধো যস্য সূর্যঃ/ সোমাৎ পর্জন্য ওষধয়ঃ পৃথিব্যাম্’ শ্লোকেও সেই সুর: পরমপুরুষ হতে সেই দ্যুলোক জাত হয় যার ইন্ধন সূর্য, (দ্যুলোকসম্ভূত) চন্দ্র থেকে মেঘ, (মেঘ থেকে) পৃথিবীতে ওষধিসমূহ জাত হয়। ছান্দোগ্যোপনিষদেও রয়েছে এই ভাবনা। দার্শনিকতার চর্চার মধ্যেও ঘুরে ঘুরে এই কথাগুলি বলা হচ্ছে, কারণ আদি-অকৃত্রিম প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহজ স্বাভাবিক আন্তঃসম্পর্কটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই ধারণা শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেও। ঐতরেয়োপনিষদে ‘বিরাট’-এর কল্পনা রচিত। তার মধ্যে পৃথিবীর প্রাণমণ্ডল যেন আস্তৃত। বলা হচ্ছে— ওই বিরাটই পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল, তেজঃ, ইনিই সমস্ত ধরনের প্রাণী, সর্পাদি, অণ্ডজ-জরায়ুজ-উদ্ভিজ্জ জীব, অশ্ব, গো, পক্ষী এবং মানুষ, সমস্তই।
প্রশ্ন আসবে, তবে কি মানুষ এগোবে না? প্রকৃতির কাছ থেকে যে ভাবে যতটুকু পেয়েছে, ততটুকুর মধ্যেই জিইয়ে রাখবে নিজের সত্তাকে? মোটেই নয়। শ্রী-সম্পদের ভাবনাও উপনিষদে আছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদের ‘আবহন্তী বিতন্বানা। কুর্বাণাহচীরমাত্মনঃ।’ শ্লোকে বলা হচ্ছে— হে ওঙ্কার, প্রজ্ঞাসম্পাদনের পর লক্ষ্মীর স্বজন আমার জন্য লোমশপশুসমন্বিতা এবং অপরাপর পশুগণে সমাবৃতা সেই লক্ষ্মীকে তুমি আনয়ন করো, যিনি সর্বদা আমার জন্য বস্ত্র, গো, অন্ন এবং পানীয় বস্তু আহরণ করবেন, ওই সমুদয় বর্ধিত করবেন এবং দীর্ঘ কাল ওই সকলের সুব্যবস্থা করবেন। এ ভাবনা কিন্তু ওই আদি-অকৃত্রিম পরিসরের মধ্যেই শ্রী-র সাধনা। তবে যতটা সম্ভবপর ততটা উন্নতিই কাম্য। উন্নতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে বিপর্যয় তরান্বিত করা নয়। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যেই জীবনধারণের পথ খুঁজতে হবে। আদি ও আদিম ‘রিসোর্স’ তো বাড়বে না! জীবনকে যুঝতে ও বুঝতে ভাবনা, পরিকল্পনা দরকার। সেই পরিকল্পনার কথাও পুরাণে রয়েছে। ভগবান ব্রহ্মা মরীচি প্রমুখ মানসপুত্র, নারদ এবং প্রজাপতি দক্ষকে সৃষ্টি করলেন। জগতের বৃদ্ধির জন্য ব্রহ্মা দক্ষকেই প্রজাসৃষ্টিতে আদেশ করলেন। দক্ষ ব্রহ্মার আদেশে প্রজাসৃষ্টিতে বৃত হলেন। পত্নী বীরিণীর গর্ভে তাঁর পাঁচ হাজার পুত্রের জন্ম হল। পুত্রেরা প্রজাবৃদ্ধিতে প্রবৃত্ত হলে নারদ তাঁদের বললেন— তোমরা কি পৃথিবীর পরিমাণ জানো? যদি না জানো, তবে কী জন্য প্রজাসৃষ্টিতে উদ্যত হলে? ভূতলের বিষয় না জেনে এ কাজ করা ভাল নয়, পৃথিবীর আয়তন জেনে এসে তার পর প্রজাসৃষ্টি করো। এখানে নারদ আসলে ‘রিসোর্স’-এর খোঁজ নিচ্ছেন। মোট মজুতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপভোক্তা-সংখ্যা নির্ণয় করছেন।
আর আমরা? প্রকৃতিকে বিনষ্ট করছি, বিপন্ন করছি বাস্তুতন্ত্র। লকডাউন চোখের সামনে থেকে সভ্যতা-স্রোতের মোহ-পর্দাটা খানিক সরিয়ে দিয়ে দেখিয়ে গেল, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর চেহারা ঠিক কেমন হওয়ার কথা ছিল। পৃথিবী যেন অনেকটা গুছিয়ে-থিতিয়ে সুসংহত হয়ে নিল। পার্কগুলিতে জাগল হরেক পাখির কলতান, আবহাওয়াতেও পরিষ্কার পরিবর্তন।
এই সব দেখেশুনে চার পাশের পৃথিবীটাকে অন্য চোখে দেখতে শেখা দরকার। প্রয়োজন কমাতে শেখা। যতটুকু না হলে নয়, ততটুকুতে সন্তুষ্ট হতে শেখা। শহরকে অনাবশ্যক না বাড়াতে শেখা। অরণ্যের নিয়তবিনষ্টি থেকে দূরে থাকতে শেখা। নদীকে সুস্থ ভাবে বইতে দিতে শেখা। বন্যপ্রাণের ঘরে হাত না বাড়াতে শেখা, কেননা ওদের পরিসর না দিলে ওরা ক্রমশ আমাদের ঘাড়ের উপর চলে আসবে। এ সব যদি আমরা শিখতে পারি, তা হলে কোন প্রাণী থেকে কী রোগ ছড়াল, এ নিয়ে আর অরণ্যে রোদন করতে হবে না।