বিষ্ণুপুর ব্লকে দ্বারকেশ্বর নদে হাতির পাল। ফাইল চিত্র
‘গজশাস্ত্র’-এ (পালকাপ্য মুনি রচিত) প্রাচীন উত্তর ভারতে হস্তি-বনের সংখ্যা ছিল আটটি। ‘প্রাচ্য’, ছেদিকরপস’, ‘দর্সান’, ‘অঙ্গ’, ‘কলিঙ্গ’, ‘অপরান্ত’, ‘সৌরাষ্ট্র’, ‘পঞ্চনদ’। লেখক সম্ভবত উত্তর ভারতীয় ছিলেন। সে কারণে দাক্ষিণাত্যের হস্তী-অরণ্যের উল্লেখ নেই।
প্রাচীন ভারতে হস্তী-তত্ত্ব বেশ সমৃদ্ধ ছিল। নীলকান্তের ‘মাতঙ্গলীলা’ (হাতিপালন ও চিকিৎসা), ‘হস্তী আয়ুর্বেদ’ (পালকাপ্য রচিত), ‘বৃহৎসংহিতা’ (বরাহমিহির), ‘গজশাস্ত্র’ (পালকাপ্য), ‘মনসোল্লাস’ (সোমদেব), কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, ‘গজশিক্ষা’ (নারদ), ‘গজগ্রহণপ্রকার’ (নারায়ণ দীক্ষিত) প্রভৃতি সংস্কৃতগ্রন্থ এ কথার সাক্ষ্য। হস্তী-কথা আঞ্চলিক ও লোকসাহিত্যেও প্রচলিত ছিল।
সে কালে হাতির ব্যবহার ছিল যানবাহন, মালবাহন, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এবং প্রধানত যুদ্ধের কাজে। হাতির ব্যবহার হয়েছে সিন্ধু সভ্যতায়, বৈদিক যুগে ও তৎপরবর্তী যুগে। যুদ্ধে অপরিহার্য ছিল ৫০০ খিস্ট-পূর্বাব্দ থেকে। ইরান, মিশর, রোম প্রভৃতি দেশে ১০০ খ্রিস্টাব্দে। কম্বোডিয়া, সুমাত্রা ২৫০ খ্রিস্টাব্দে। ভারতবর্ষে রাজন্যবর্গ নন্দবংশ, কী মৌর্য বংশের উদাহরণ টেনে বলা যায়, সে সময় যুদ্ধ বিগ্রহে প্রধান ভূমিকা ছিল হাতির। সে কারণে বন্য হাতি সংগ্রহ করা এবং তার পালন, প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
ফলে, হাজারে হাজারে বন্য হাতি সংগ্রহ শুরু। তাদের জন্য পৃথক কৃষিক্ষেত্রও নির্দিষ্ট হল। কিন্তু সঙ্গে চলল যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির নিধন। যুদ্ধের উপঢৌকন হিসেবেও হাতির ব্যবহার ছিল। ভারত থেকে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার শিখে নেয় পশ্চিমের পারস্য, গ্রিস, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ। তবে চিন করেনি। রাজার ‘হাতি-অরণ্য নাশ-যুদ্ধ’ এই চক্রে অপচয় হতে থাকে হাতির। উনবিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধে বারুদ প্রচলিত হলে, হাতি বাতিল হয়। তবে হাতিরা নিস্তার পায় না। এ বার তারা মালবাহক। অথচ, উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে হাতি কিন্তু এক আদরণীয় পশু।
একদা ছিল হাতির ইচ্ছেমতো অরণ্য দলন। রাজ দরবারেও তার সম্মান মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। মন্দিরেও। রাজার আভিজাত্য ছিল তাদের পালনে সংগ্রহে ও পোষণে। আপাতত ঐরাবতের বাসস্থান সঙ্কটে। বনান্তরের ‘করিডর’ অদৃশ্য। অরণ্য সঙ্কুচিত। অবলুপ্ত বহু জায়গায়। কারণ, ব্যারাজ, রিজ়ার্ভার, টানেল, ক্যানাল, নগরী, উপনগরী, এরোড্রোম, সৈন্য শিবির, পারমাণবিক পরীক্ষণ ক্ষেত্র, যোজনান্তরের রেলপথ, রাজপথ, প্রভৃতি নির্মাণ। বেড়েছে বাজার, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক ক্ষয়। হ্রাস পেয়েছে অরণ্য, বৃষ্টি, আবাসভূমি ও চারণক্ষেত্র। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব বেড়েছে। হাতিরা এক নদী থেকে সন্নিহিত নদীতে যেতে পারে না। নদী হারিয়ে গিয়েছে। জলাধার সঙ্কুচিত। মালভূমির খনিজ পাহাড় ন্যাড়া। উন্নয়নে হাতি বন্দি। আপাতত ছোট ছোট কুঞ্জেও হাতি থাকে। লবণ-মাটি নেই, পেয় জল নেই। প্রজনন ভূমি নেই। হাতিরা শস্য তস্করতায় নেমেছে তাই। রেলপথে, রাজপথে বৈদ্যুতিক স্পর্শে প্রাণ যাচ্ছে তাদের। ২০১২-১৭র মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ভারত জুড়ে। ট্রেন দুর্ঘটনা, বিষ প্রয়োগ, বিদ্যুৎ স্পর্শ, হত্যা প্রভৃতি কারণে। এ দিকে, হাতির কারণে মানুষের জীবনহানিও ঘটছে। হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি। এ সবের কারণেই স্থানীয় মানুষের সঙ্গে অবিরত সংঘাত।
আপাতত আলোচ্য দক্ষিণ বাংলার অরণ্যবাসী হাতি— যাদের চলাচল মূলত পুরুলিয়া-বাঁকুড়া, বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বুকে। ময়ূরঝর্না এলিফ্যান্ট রিজার্ভের অবস্থান মধ্যে। জেলাগুলোর উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের অরণ্য অঞ্চল। দক্ষিণে ওড়িশার বনভূমি। গাঙ্গেয় পূর্ব ও পশ্চিমে পার্বত্য ছোটনাগপুর। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এ সব অঞ্চলে হাতির কারণে মানুষের জীবনহানির সংখ্যা ১০৩ (২০১০-২০১৬)। যার বেশিটা মূলত পাঞ্চেত, রূপনারায়ণ, মেদিনীপুর বনবিভাগে। দক্ষিণ বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রামে অপেক্ষাকৃত কম।
ভারতবর্ষের উত্তর, উত্তর-মধ্য, উত্তর-পূর্ব আর দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য বনাঞ্চলে এই বন্য হাতির অবস্থান। সর্ব শেষ ‘সেনসাস’ (২০১৭) অনুযায়ী ভারতে, হাতির (এশিয়ান ভ্যারাইটি) সংখ্যা ২৭,৩১২। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গে ৪৮৪, দক্ষিণবঙ্গে ১৯৪ (২০১৭)। নিকটবর্তী ঝাড়খণ্ডের অরণ্যে (পলামৌ, সারান্ডা, চাইবাসা, সরাইকেলা, রাঁচী, গুমলা, ধানবাদ, জামশেদপুর) ৬৭৮।
ভারতে হাতি-পথ (করিডর) একশোর আশপাশে। পশ্চিমবঙ্গে এর এক চতুর্থাংশ। ‘করিডর’-এর বিলুপ্তি ঘটেছে উন্নয়নকেন্দ্রিক কারণে। কী উত্তরে, কী দক্ষিণ ভারতে। আর ‘করিডর’ না পেয়েই তারা ছুটে বেড়ায় নগরে গ্রামে শস্যক্ষেত্রে। মৃত্যু হাতে নিয়ে। যেমন, ওড়িশার ঢেঙ্কানলে দুর্ঘটনায় সাতটি হাতি মারা গেল। উত্তরবঙ্গে বিগত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনায় হাতির মৃত্যুর ‘বুলেটিন’ বেরোয়। গত ১০ বছরে কেরলে শতাধিক হাতি মরেছে বিদ্যুতের স্পর্শে।
উত্তরবঙ্গে আপাতত বক্সা, গরুমারা, জলদাপাড়া, মহানন্দা, চাপড়ামারি, নেওড়াভ্যালি হাতিদের বাসভূমি। যাতায়াত নেপাল, অসম, ভুটানে। এখানেও বহু ‘করিডর’ নিরুদ্দেশ। মানুষের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত এখানেও। দক্ষিণবঙ্গের শাল অরণ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর। দলমার হাতিদের অনেকে এখানে ১৯৮৭ সালে প্রবেশ করে। পরে ‘রেসিডেন্ট’ হয়ে য়ায়। ঝাড়খণ্ডে ভঙ্গুর অরণ্যের কারণে এবং সফল জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও উন্নত কৃষিতে হাতির শস্য লোভ বেড়েছে। ওড়িশা আগত তারা ময়ুরঝর্নাতে আশ্রিত হয়। দলমা রেঞ্জ ভঙ্গুর হয়েছে খনিজ উত্তোলন ও ভারী কারখানা নির্মাণে, সুবর্ণরেখা প্রকল্প প্রভৃতি কারণে।
আসলে পরিবেশে পশু ও মানব সংঘাত এবং প্রজাতি আয়ুর কামনা যুগপৎ। তাই পশুমঙ্গলের দু’একটি কথা বলে তাদের অধিকারের কথা বন্ধ রাখা হয়।
সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার