এ ভাবেই জমে থাকছে ই-বর্জ্য। ছবি: আইস্টক
বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্জ্য পদার্থ বিশেষ করে জৈব পচনশীল বর্জ্য পদার্থ প্রক্রিয়াকরণের জন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। মৃত প্রাণীর দেহ ফেলার জন্য ভাগাড় তৈরি করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাগাড়ের বিলুপ্তি ঘটলেও এখন কতগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে জৈব বর্জ্য পদার্থ ফেলা হয়। বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, পৃথিবীতে শক্তি এবং সম্পদের সঞ্চয় যে হারে কমছে তার জন্য বর্জ্য পদার্থগুলিকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলা একান্ত দরকার। সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়েই তৈরি হয়েছে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। এই শিল্পের মাধ্যমে বহু পদার্থকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কঠিন বর্জ্য পদার্থে আরও একটি জিনিস সংযুক্ত হয়েছে, সেটি হল ই-বর্জ্য বা ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য পদার্থ। এগুলির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা করা আমাদের পরিবেশনীতির অন্যতম কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাবের এখন আকছাড় ব্যবহার হয়। এর ফলে কাগজের ব্যবহার অনেকটাই কমেছে। তার জেরে কমেছে গাছ কাটার সংখ্যাও। পরিবেশের উপরে এর সদর্থক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু, পরিবেশে এক নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ‘ডিজিটাইজেশন’-এর হাত ধরে ইলেক্ট্রনিকস দ্রব্যের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এক নতুন ধরনের বর্জ্য পদার্থ যাকে আমরা ই-বর্জ্য বলছি। পুরনো, ব্যবহারের অযোগ্য ইলেক্ট্রনিকস দ্রব্যকে ‘ই-ওয়েস্ট’ বা ইলেক্ট্রনিকস বর্জ্য বলা হয়। যে কোনও ইলেক্ট্রনিকস দ্রব্য, যেমন রেডিয়ো, মিউজিক সিস্টেম, টিভি, ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, পেন ড্রাইভ, চার্জার প্রভৃতি ব্যবহারের পর যখন বর্জন করা হয় তাঁকে ‘ই-ওয়েস্ট’ বলা হয়। আধুনিক পৃথিবীতে প্রতি দিন বৈদ্যুতিন দ্রব্যের নিত্যনতুন মডেল বাজারে আসার ফলে পুরনো জিনিসগুলি আর তেমন ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তার ফলে দ্রুত গতিতে বাড়ছে বৈদ্যুতিন বর্জ্যের পরিমাণ।
বৈদ্যুতিন বর্জ্যে যে ধাতব ও অধাতব উপাদানগুলি থাকে তা হল, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রুপো, প্যালাডিয়াম, প্লাটিনাম, নিকেল, টিন, লেড (দস্তা), লোহা, সালফার, ফসফরাস, আর্সেনিক প্রভৃতি। বিজ্ঞানীদের দাবি, পরিবেশের সঙ্গে এগুলি মিশলে তা প্রভূত ক্ষতি করতে পারে। এই ই-বর্জ্যে থাকা অ্যান্টিমনি মৌলটির কারণে চোখ, ত্বক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার এই দ্রব্যের সঙ্গে থাকা বিসমাথ থেকে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের ক্ষতি, অনিদ্রা, হতাশা, হাড়ের যন্ত্রণা প্রভৃতি বাড়ে। ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতু ফুসফুসের ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, পাকস্থলীর সমস্যা, আলসার, অ্যালার্জি প্রভৃতির জন্য দায়ী। অধিক মাত্রায় দেহে প্রবেশ করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কোবাল্ট থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও চোখ। থাইরয়েডের সমস্যা, অ্যাজমা প্রভৃতির জন্যও কোবাল্ট দায়ী। ই-বর্জ্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষতিকর উপাদান হল মলিবডেনাম। এটি থেকে হাত, পা, হাঁটু, কনুই প্রভৃতি অঙ্গে ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। বহু ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যে লেড বা সিসা ব্যবহৃত হয়। এই উপাদানটি জীবজগৎ ও পরিবেশের পক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিকর। এই উপাদানটি কোনও ভাবে মানবদেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক, কিডনির প্রভূত ক্ষতি হতে পারে। দেখা দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও। সন্তান উৎপাদন ও ধারণক্ষমতার বিশেষ ক্ষতি এবং শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশও ব্যাহত হতে পারে সিসার কারণে। এ ছাড়াও বহু ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যে টিন ব্যবহৃত হয়। টিন থেকে ত্বক ও চোখের চুলকানি, মাথার যন্ত্রণা, বদহজম, শ্বাসকষ্ট ও মূত্রাশয়ের রোগ দেখা দেয়। ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যে অনেক সময় নিকেলের প্রলেপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই নিকেল থেকে ফুসফুস, নাক, প্রস্টেট প্রভৃতি অঙ্গে ক্যানসার সৃষ্টি হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত গতির জন্যও নিকেলকে দায়ী করা হয়ে থাকে।
ই-ওয়েস্ট-এ থাকা ধাতব উপাদান মাটি ও ভূ-গর্ভস্থ জলকে দূষিত করে। ক্যাডমিয়ামের প্রভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঠিক ব্যবস্থাপনার (ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) মাধ্যমে ই-বর্জ্য পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাবকে অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। ধাতব এবং অধাতব যে উপাদানগুলি ই-বর্জ্যে থাকে তার পৃথকীকরণ এবং সংগ্রহের মাধ্যমে সেগুলিকে নতুন করে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই উদ্দেশ্যে ই-বর্জ্য জমা ও বাছাই করার জন্য স্তূপ আকারে রাখার হয়। তার পরে ভেঙে বা গলিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই পদ্ধতিতে ঝুঁকিও রয়েছে। ই-বর্জ্য পদার্থ গলানোর সময় বাতাসে প্রচুর দূষিত গ্যাস মেশার আশঙ্কা থাকে। এই ডাই-অক্সিন মানবদেহে ক্যানসার রোগের সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ডিএনএ-র গঠনে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বৈদ্যুতিন দ্রব্যের কেসিং-এর মধ্যে থাকা পলিভিনাইল ক্লোরাইড পরিবেশের ক্ষতি করে। ফলে ঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করলে এই বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণও বড় ধরনের বিপদ ডেকে নিয়ে আসে।
ই-বর্জ্য পদার্থ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। প্রথমত, যন্ত্র ব্যবহারের ঠিক পদ্ধতি শেখা। এতে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব বেশি দিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে পুরনো সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানোর উপরে। একই যন্ত্র একাধিক কাজ করবে এমন মাল্টিপারপাস ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। একই চার্জারে সব সংস্থার সব মডেলের মোবাইল চার্জ করা যায়, এমন চার্জারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। আইনের মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিকে রিসাইকেলিং বা পুনরুৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। ই-ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্মের ব্যবহার, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে আশার কথা, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, পুরসভা, পঞ্চায়েত এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি ধীরে ধীরে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বিক্রয়কারী সংস্থাগুলি ব্যবহৃত পুরনো সামগ্রী সংগ্রহ করে তা রিসাইক্লিং-এর ব্যবস্থা করেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত কর্মসূচি নিতে হবে। এখন থেকে আমরা সচেতন না হলে ভবিষ্যতে ই-বর্জ্য আমাদের জীবনে এক অন্যতম অভিশাপে পরিণত হবে।
আরআরএস কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক