ছবি: সংগৃহীত
অশিক্ষা-কুশিক্ষায় কেউ প্রাণে মরে না। সেটা সৌভাগ্য, কিন্তু মহামারি লাগলে শিক্ষার পাট তছনছ হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই দুর্যোগেও নয়া শিক্ষানীতি শুধু ঘোষণা নয়, কার্যকর করতে লেগেছে। এতে কী লাভ হবে তা অবশ্য রহস্যই থেকে যাচ্ছে।
তবে আমার আজকের আলোচনা নতুন নীতি নিয়ে নয়, কোভিড-কালে শিক্ষা-সমস্যার জরুরি তাৎক্ষণিক মোকাবিলা নিয়ে। ইউজিসি-র হুকুম (নিজেদেরই আগের নির্দেশ বাতিল করে), সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো পরীক্ষার পালা শেষ করতে হবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতণ্ডা বেধেছে, ফলে এটা যে কত অসম্ভব তা নিরপেক্ষ ভাবে বোঝানো মুশকিল। ছাত্রেরা যেখানে সংখ্যায় অল্প ও আর্থিক ভাবে সচ্ছল (প্রায় সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে), সেখানে অনলাইনে পরীক্ষা হতে পারে। হচ্ছেও। সব শ্রেণির ছাত্রে ভরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে, সর্বোপরি কলকাতা বা দিল্লির মতো বহু কলেজ সংবলিত বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমন ভাবাই বাতুলতা। অনলাইন বা সশরীরে পরীক্ষা, দু’টোই সমান অবাস্তব। তা ছাড়া, সিমেস্টার তথা সিবিসিএস ব্যবস্থার কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনও পাঠ্যক্রমের শেষ বর্ষের ছাত্রদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ মূল্যায়ন হয়ে গিয়েছে। ফলে বেশি আপস না করেও আগের পরীক্ষার ভিত্তিতে ফর্মুলা কষা চলে, নানা বোর্ডের পরীক্ষায় যেমন হয়েছে। তবে চাইলে কেউ যেন পরে পুরোদস্তুর পরীক্ষায় বসে নম্বর বাড়ানোর সুযোগ পায়, তারও একটা ব্যবস্থা দরকার।
একই যুক্তিতে, ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস চালু করা অবাস্তব। অবুঝ হলে চলবে না। সকলেই চায়, অচলাবস্থা কাটুক। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে স্থির পরিকল্পনার প্রশ্ন নেই। বার বার তারিখ ঘোষণা আর বাতিল করা কাম্য নয়, আর জনস্বাস্থ্য বিপন্ন করে স্কুল-কলেজ খোলা অবশ্যই মারাত্মক। ছেলেমেয়েদের আমরা কত দিন দোলাচলে রাখব? কত ঝুঁকি নেব অতিমারি নিয়ে? সময়টা অস্বাভাবিক— অভ্যস্ত সূচি আঁকড়ে থাকার ব্যর্থ চেষ্টার বদলে গঠনমূলক ভাবে বিকল্প উপায় খোঁজাই ভাল। সেটাও হয়তো খাটবে না; তবু কিছু ছাড় রেখে হিসেব করলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেরই শেষে স্বস্তি, এখন যতই অধৈর্য লাগুক।
অতএব পুজোর আগে ক্লাস শুরু করা যাবে না, অপেক্ষা করতে হবে ডিসেম্বর, হয়তো জানুয়ারি পর্যন্ত। সে-ক্ষেত্রে ২০২১-এর গ্রীষ্মের ছুটিটা উঁচু ক্লাসে বাতিল আর নিচু ক্লাসে কমিয়ে দিয়ে, জুলাইয়ের মধ্যে পঠনপাঠন শেষ করে, অগস্টে পরীক্ষা নিয়ে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের গোড়ায় ফল প্রকাশ করা যায়। শিক্ষাবর্ষের লয় খানিক দ্রুত করতে হবে অবশ্যই। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস স্বাভাবিক নিয়মেই আগে শেষ হয়, ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল পুজোর আগে ঘোষণা, এবং হয়তো পরবর্তী ভর্তির পাটও চুকিয়ে ফেলা যাবে। ইতিমধ্যে ২০২১-এর অগস্ট থেকে পরের শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু করলে ২০২২-এ স্বাভাবিক সময়ের অল্প পরেই— ধরা যাক মে মাসের মধ্যে— শেষ করা যাবে; পরীক্ষাও নেওয়া যাবে অল্প দেরিতে। ২০২২-এর নতুন শিক্ষাবর্ষ প্রায় ঠিক সময়েই শুরু করা যাবে। ২০২১ ও ২০২২-এ দু’-তিন মাস শিক্ষকদের কিছু বাড়তি চাপ যাবে। আশা করি, সেই কষ্ট তাঁরা ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে স্বীকার করবেন।
দু’টো প্রশ্ন উঠতে পারে। ধরা যাক, উচ্চশিক্ষার বর্ষসূচিও এক ছন্দে চলল। ২০২০ এবং হয়তো ২০২১-এ তবে বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফাইনাল পরীক্ষার ফল দেরিতে বেরোবে, তার কী হবে? এর উত্তর, ভর্তির ব্যাপারে দেশের সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধন করতেই হবে। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি ঝগড়া ভুলে এটুকু সুনিশ্চিত করবে, আশা করা অন্যায় নয়। গন্তব্য বিদেশে হলেও সর্বনাশ হবে না। কোভিডে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলিও যথেষ্ট মাত্রায়, বিশেষত আর্থিক ভাবে। ভিন্দেশের ছাত্র তাদের রোজগারের একটা বড় রাস্তা। বেশ কিছু দিন তাদেরও পঠনপাঠনের অনেকটা হবে অনলাইন। অতএব ভর্তি ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, আগামী ক’মাস কি তবে ছাত্র-শিক্ষক চুপচাপ বসে থাকবেন? ছাত্রেরা আগের পড়া ভুলতে থাকবে, এমনকি স্কুলের অস্তিত্বের কথাও? পাঠ্যক্রম ধরে পুরোদস্তুর পঠনপাঠন বর্তমান অবস্থায় সম্ভব নয়, বিশেষত স্কুল স্তরে। বাড়ি বসে একটানা লেখাপড়ার পরিবেশ অনেক সম্পন্ন ঘরেও নেই, গরিব ঘরে কোন ছার। মনঃসংযোগের প্রশ্নও আছে। সম্ভব কেবল আগের পড়া স্মরণে রাখা, অনুশীলনের মাধ্যমে লেখাপড়ার অভ্যাস ধরে রাখা, আর পরের ক্লাসের খানিক প্রস্তুতি সেরে নেওয়া।
এ বার গ্রাম-বস্তি-কলোনিতে দারিদ্র চরমে উঠেছে। অভিভাবকেরা নাজেহাল, অনেক সন্তানও রোজগারের রাস্তা দেখছে। এই সমস্যার সমাধান শিক্ষাব্যবস্থার হাতে নেই। তবে যেখানে পড়ুয়ারা বাড়ি বসে রয়েছে, কিছু উপায় ভাবা যায়। অনলাইন ক্লাস মোটেই একমাত্র পন্থা নয়। অন্য কিছু ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাড়ু বা পঞ্জাব ইতিমধ্যে নিয়েছে, ফলে পরিকল্পনার একটা খুঁটি পাওয়া যাচ্ছে। আমার আলোচনা সরকার-পোষিত স্কুলের, বিশেষত গরিব ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রদের নিয়ে। সৌভাগ্যবানেরা নিজেদের পথ দেখে নিতে পারবে।
লকডাউনের গোড়ায় মিড-ডে মিলের সামগ্রীর সঙ্গে সরকার কিছু লেখাপড়ার রসদও দিয়েছিল, অ্যাক্টিভিটি টাস্ক বা ওয়ার্কশিটের আকারে। লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ায় এ বার শিক্ষকেরা সেগুলি জমা নেবেন, ধরা যাক, দেখে ছাত্রদের ফেরতও দেবেন। এই আদানপ্রদান আরও ব্যাপক ও নিবিড় করলে— মাসে এক বার নয় প্রতি সপ্তাহে— লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা কিছুটা বজায় থাকবে। সেই পাঠ্যবস্তু সরকার কেন্দ্রীয় ভাবে পাঠাতে পারে, বা শিক্ষকেরা তৈরি করতে পারেন নিজেদের মতো করে, হয়তো একাধিক স্কুল বা একটা অঞ্চল মিলে।
নানা জায়গায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে শিক্ষক ও স্থানীয় সমাজের উদ্যোগে ছেলেমেয়েদের ফাঁকা জায়গায় দূরে দূরে বসিয়ে ‘লকডাউন স্কুল’ চলছে। কিছু মাদ্রাসায় অভিভাবকদের সন্তানের শিক্ষার দেখভালের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই ব্যবস্থা ব্যাপক হতে পারে অভিভাবক সমিতিগুলিকে সক্রিয় ভাবে যুক্ত করে। স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক কারণে সর্বত্র সব উদ্যোগ সম্ভব নয়, বিশেষত শহরাঞ্চলে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল। সরকারি নির্দেশ জারি তাই অসমীচীন হবে; সে-ক্ষেত্রে তো স্কুল খুলেই দেওয়া যেত। তবে সম্ভাব্য উপায়গুলি (এবং তাতে কী সতর্কতা মানতে হবে) প্রস্তাবের আকারে সব শিক্ষক সংগঠনের মধ্যে নিশ্চয়ই প্রচার করা চলে— কী পড়ানো যায় তারও একটা রূপরেখা। আর উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সপ্তাহে এক বার, ভাগে ভাগে অল্প সংখ্যায়, হয়তো সরকারি ভাবেই প্রশ্ন ও পরামর্শের জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে মুখোমুখি মিলিত হতে পারে।
অতঃপর অনলাইন ব্যবস্থা। কোভিড-কালে সন্তানের অনলাইন লেখাপড়ার জন্য কিছু পরিবারের আত্মত্যাগ মনে ধাক্কা দেয়। এক পিতা রুজির সহায় দুধেল গরুটা বেচে দিয়েছেন, এক মা বেচেছেন একমাত্র সোনার দুলজোড়া। স্মার্টফোনের অভাবে লেখাপড়া বন্ধে কিছু ছেলেমেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। সমস্যার সমাধান কঠিন, কিন্তু সমস্যা যে আছে, দিল্লির ভিন্গ্রহে সে বার্তা পৌঁছয়নি। সেখানকার কর্তারা অনলাইন শিক্ষায় তাঁদের ক’টা সাইট, তাতে কত গুণ বেশি ‘হিট’ হচ্ছে, সেই হিসেবেই আহ্লাদিত। রাজ্য সরকারকে খানিক বাস্তবপন্থী হতেই হয়, যার শেষ দৃষ্টান্ত ফোনে নিঃশুল্ক হেল্পলাইন। উদ্দেশ্য সাধু এবং ইতিমধ্যেই ফলপ্রসূ, কিন্তু কয়েক লক্ষ ছাত্রের কাছে এ ভাবে পৌঁছনো যাবে কি না, প্রশ্ন।
বৈদ্যুতিন শিক্ষামাধ্যম প্রভূত সম্ভাবনাময়। আমাদের ছাত্রদের একটা বড় অংশ তার সুযোগ পায় না, অর্থাভাবে বা সংযোগের অভাবে। তাই বলে যদি আমরা মাধ্যমটাই ত্যাগ করি, অভাব কোনও দিন দূর হবে না, শিক্ষাব্যবস্থা উত্তরোত্তর দুর্বল হয়ে পড়বে। তবে অসংখ্য ছাত্রকে বঞ্চিত করে ব্যবস্থা চালু করাও কোনও সুস্থ শিক্ষানীতির অঙ্গ হতে পারে না। এই চ্যলেঞ্জের স্থায়ী সমাধান না খুঁজলেই নয়। তার আগে আপৎকালীন ব্যবস্থার কথা ভাবা দরকার।
‘বৈদ্যুতিন’ ব্যবস্থা লিখেছি, ‘অনলাইন’ নয়। আন্তর্জাল বিনা অফলাইন পঠনপাঠনের নানা উপায় আছে, সেগুলিও ভাবা দরকার, বিশেষত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে। এই মুহূর্তে হয়তো আন্তর্জাল ছাড়া উপায় নেই। এগুলি কিন্তু ‘রিয়েল টাইম’ সম্প্রচার নয়, যে কোনও সময় ডাউনলোড করা চলে; টিভির অনুষ্ঠানগুলিও করা চলে, ইউটিউব থেকে। এতে ব্যবস্থাটা অনেক নমনীয় হচ্ছে। একই স্মার্টফোন পালা করে অনেক ছাত্র দেখতে পারে; পারে দিনের শেষে অভিভাবক বাড়ি ফিরলে, বা আত্মীয়বন্ধুর ফোন ধার নিয়ে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়