ছবি: রয়টার্স।
লালকেল্লা হইতেও প্রধানমন্ত্রী ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়িবার ডাক দিয়াছেন। গোটা দুনিয়ার উৎপাদন কেন্দ্র হইয়া উঠিবার কথাটিও জুড়িয়া দিয়াছেন। গত কয়েক মাসে ভারতীয় অর্থনীতি যে পথে চলিয়াছে, তাহার সহিত প্রধানমন্ত্রীর এই দুইটি কথাকে জুড়িলে যে নীতিটির অবয়ব ফুটিয়া উঠে, তাহা এই রকম: আমদানি বন্ধ করিয়া ভারত দেশেই পণ্য উৎপাদনের উপর জোর দিবে; এবং, রফতানির বাজারটি বাড়াইবার চেষ্টা করিবে। অর্থশাস্ত্রের ছাত্রমাত্রেই বুঝিবেন, এই দুইটি নীতি চরিত্রে বিপ্রতীপ— দরজা হয় বন্ধ থাকিবে, নয় খুলিবে। অর্থনীতিতে শ্রোডিংগারের বিড়ালের জায়গা নাই। কিন্তু সেই তর্কটি বকেয়া থাকুক। দেশের প্রয়োজনে কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া দেশের উৎপাদকদের বিশ্বমানে পৌঁছাইবার সুযোগ করিয়া দেওয়া সম্ভব, ক্ষেত্রবিশেষে উচিতও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হইল, অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমদানি বন্ধ করিয়া স্বদেশের উৎপাদনের যে নীতির গায়ে ইন্দিরা গাঁধী-যুগের অনপনেয় গন্ধ, এবং ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বহু মূল্যে যে নীতির কুফল বুঝিয়াছে— প্রধানমন্ত্রী আবার সেই নীতির নিকট ফিরিয়া যাইবেন কেন? বিশ্ব-অর্থনীতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার অর্থ— দেশে ফের লাইসেন্স রাজের প্রত্যাবর্তন হইবে, অর্থনৈতিক কুশলতা নষ্ট হইবে, কায়েমি স্বার্থগুলি আরও বেশি জাঁকিয়া বসিবে। তাহাতে দেশের ক্রেতাদের স্বার্থহানি হইবে। ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর এহেন চেহারাই কি প্রধানমন্ত্রীর কাম্য?
উদার অর্থনীতির সহিত ভারতে উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার, বা তাহার কুশলতা বৃদ্ধির কোনও বিরোধ নাই, বরং সাযুজ্য রহিয়াছে। ভারতীয় পণ্য যদি গুণমানে এবং মূল্যে আন্তর্জাতিক পণ্যের তুলনায় ভাল হয়, মানুষ তাহা আপনিই কিনিবে। অর্থাৎ, প্রয়োজন ভারতীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করিয়া তোলা। কথাটি বিদেশের বাজারের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযোজ্য। কী কারণে ভারতীয় পণ্য বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট সক্ষম হইতেছে না, তাহা দেখিতে হইবে। অভ্যন্তরীণ করকাঠামো কি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করিতেছে? লালফিতার ফাঁসে আটকাইয়া উৎপাদন ব্যয় বাড়িতেছে? কাঁচামাল ও অন্তর্বর্তী পণ্যের জোগান-শৃঙ্খল কি যথেষ্ট কুশলী নহে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা বিধেয়।
কেহ বলিতেই পারেন, যে ভাবেই হউক ভারতকে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশ্বশক্তি হইয়া উঠিতে হইবে। সেই বাজারে ভারতের দখল প্রতিষ্ঠা করা ভিন্ন সাধনার ফল— তাহার জন্য শুধু স্লোগান রচনা করিলেই চলিবে না, ভারত বরং নিজের শক্তির দিকে নজর দিলেই ভাল করিবে। বিশ্বায়নের তিন দশকে ভারত বিশ্বমঞ্চে পরিচিত হইয়াছে তাহার পরিষেবা ক্ষেত্রটির জন্য। এবং, এই ক্ষেত্রেই ভারত ক্রমে মূল্যশৃঙ্খলের উচ্চতর ধাপে পা ফেলিতে পারিয়াছে। উৎপাদন ভারতের শক্তির জায়গা নহে— এবং, এই দেশের পণ্য রফতানির অধিকাংশই হয় প্রাথমিক পণ্য, নয় উৎপাদনের মূল্যশৃঙ্খলের অতি নিম্ন স্তরে থাকা পণ্য। যেখানে জোর আছে, সেই জায়গাটিকেই মজবুততর করিয়া তোলাই কি সীমিত সাধ্যের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার নহে? দুই বা আড়াই শতক পূর্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধ্রুপদী চিন্তকরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়াছিলেন, যাহার যেখানে জোর, সেই দেশ সেই বস্তুটি রফতানি করিলেই সার্বিক মঙ্গল। কথাটি সময়ের পরীক্ষায় অকারণে উত্তীর্ণ হয় নাই।