অধিকার: অতিমারির আবহেও দীর্ঘ হয়েছে ভোটের লাইন। ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা। রয়টার্স
দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল বিল ক্লিন্টনের নির্বাচনী স্লোগান, ‘ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড’। কিন্তু আমেরিকার ভোট কি সত্যিই সেই পথে হয়েছে? বস্তুত, আমেরিকানরা যত বারই প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার জন্য ভোট দিয়েছেন, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ কখনওই তাঁদের প্রার্থী বিচারের মূল মানদণ্ড হয়নি। এ বারও নয়।
এই নির্বাচনে অর্থনীতির ভূমিকা ছিল সামান্যই। তার বদলে আবেগের সঙ্গে আবেগের লড়াই হয়েছে। দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়েছে জাতিগত আবেগ এবং অতিমারির কালে বেঁচে থাকার ইচ্ছের মধ্যে। তাই কোভিড-১৯’এর ফলে শয়ে শয়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং আমেরিকায় বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও রিপাবলিকানদের ভোট তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে।
উপরন্তু দি ইকনমিস্ট পত্রিকা হিসেব করে দেখিয়েছে যে, ইস্পাত ক্ষেত্রে যে ক’টি চাকরি বাঁচিয়েছেন ট্রাম্প, তার প্রত্যেকটিতে আমেরিকার করদাতাদের ৯ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ায় বোঝা যায়, জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী আবেগের জোরেই এই ফল সম্ভব, অর্থনৈতিক হিতাহিত কোনও ব্যাপারই নয়। এমনিতেও আমেরিকার বেশির ভাগ নির্বাচনে অর্থনীতির তেমন ভূমিকাই নেই।
বেকারত্ব সবচেয়ে কম ছিল হ্যারি ট্রুম্যানের সময়ে। সেই সুসময়ের কাছাকাছি পৌঁছেছিল লিন্ডন জনসনের আমলও। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ক্ষমতা দখল করেন রিপাবলিকানরা। ট্রুম্যানের পরে আসেন ডোয়াইট আইজ়েনহাওয়ার, জনসনের পরে রিচার্ড নিক্সন। ‘ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড’ স্লোগান-খ্যাত ক্লিন্টন দক্ষ অর্থনৈতিক জমানা পরিচালনা করলেও তাঁর পরে ক্ষমতায় আসেন রিপাবলিকান জর্জ বুশ।
যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের মতামতের প্রশ্ন, সেখানে অর্থনীতি সচরাচর বন্ধনশক্তি হয় না। ট্রেড ইউনিয়নগুলি স্পষ্ট অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বললেও শিল্পক্ষেত্রগুলি জুড়ে, এমনকি কারখানার কাজের জায়গাতেও তারা বিবদমান। পটভূমি বিস্তৃত করলে দেখা যাবে, কৃষকদের মধ্যেও মতবিরোধ। আলু আর ভুট্টা চাষিদের মধ্যে মিল নেই। কেন্দ্রের নয়া কৃষি বিপণন নীতির ক্ষেত্রে বিরোধ প্রাথমিক ভাবে কেবল হরিয়ানা আর পঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলেই হচ্ছে, অন্যত্র নয়। অর্থনীতি বিঘ্ন ঘটায়, আবেগ ঐক্যবদ্ধ করে।
বেন অ্যান্ডারসন বলেছিলেন, জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে নিজেদের একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে কল্পনা করা জরুরি, শ্রেণি বা বর্গের সদস্য হিসেবে নয়। প্রাণবন্ত জাতীয় সচেতনতার জন্য শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত ইত্যাদির সদস্য হিসেবে সচেতনতা প্রাসঙ্গিক নয়। ক্ষুদ্র শ্রেণি ও অর্থনৈতিক বর্গের উপরে উঠে নিজেদের গোষ্ঠী হিসেবে ভাবা জরুরি।
এক নতুন, উদ্দীপিত ট্রাম্পকে দেখেছিল ২০২০, যিনি আর গত বারের মতো নেতিবাচক ভোটের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। প্রায় প্রবাদপ্রতিম নেতা হয়ে ওঠেন তিনি, যাঁর কেবল রাজনৈতিক সমর্থক নয়, প্রচুর অনুগামীও রয়েছে। তিনি এমন এক আবেগের প্রচার করছিলেন, যা খোলাখুলি ভাবে রাজনৈতিক ভ্রান্তির পক্ষে। খুশি মনে সঙ্কেত বুঝে নিয়েছিলেন সমর্থকরাও। তাঁরা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, এ বার আর বর্ণ-লিঙ্গ নিয়ে কথা বলার সময় রাজনৈতিক শুদ্ধতা বজায় রাখার দায় থাকবে না। ভদ্রতাবোধ বিসর্জন দিয়ে যথেচ্ছাচারের সুযোগ মিলবে!
কোভিডবিহীন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সহজেই জিতে যেতেন রিপাবলিকানরা। বাইডেনকে কোন দিক থেকে আক্রমণ করবেন, তা নিয়ে নিশ্চিন্তে ভাবনাচিন্তা করার সুযোগ পেতেন ট্রাম্প। আমেরিকার জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ; ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ফলে তাঁদের মধ্যে তৈরি হওয়া উদ্বেগকেই ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প। পুলিশবাহিনীতে বরাদ্দ কমানোর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন অনেক ডেমোক্র্যাট, তার ফলে হতাশা তৈরি হয় বাহিনীর মধ্যেও।
ট্রাম্পের দুর্ভাগ্য, এই অতিমারি বাইডেনের হাতে আবেগের অস্ত্রও তুলে দিয়েছে। কোভিড-যুগে বেঁচে থাকার ইচ্ছের প্রতীক হিসেবে ফেস মাস্ককে তুলে ধরতে থাকে ডেমোক্র্যাটরা। সত্যি সত্যিই এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে যে, এই আবেদন গোটা দেশে সাড়া ফেলে দেয়। ভোট যত এগিয়ে আসে, তত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান সরিয়ে রেখে আস্তিন গুটাতে থাকে দু’পক্ষই। জোরদার হয় আবেগ বনাম আবেগের লড়াই। ট্রাম্প বা বাইডেন কেউই অর্থনীতি বা চাকরি নিয়ে বেশি সময় খরচ করেননি।
ভারতেও জাতীয় স্তরে বিশেষ বিবেচ্য হয় না অর্থনীতি। অর্থনীতির হিসেবে খুবই ভাল কাজ করেছিলেন নরসিংহ রাও, কিন্তু তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। আবার, সব ছাপিয়ে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত উদয়’-এর অর্থনৈতিক সাফল্যের উপর জোর দেওয়ার ফলেই বাজপেয়ী হেরে গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। নোট বাতিলের ফলে প্রচুর মানুষ চাকরি খুইয়েছেন, কিন্তু ২০১৯-এ মোদীর ব্যক্তিগত আবেদনই বিজেপি-কে অভূতপূর্ব জয় এনে দেয়।
অল্প সংখ্যক ভোটারের ক্ষেত্রে কার্যকর হয় অর্থনৈতিক আবেদন, যেখানে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও চাকরির প্রসঙ্গ মানুষকে ঘনিষ্ঠ ভাবে একত্রিত করে। ভোটক্ষেত্র যত বিস্তৃত হয়, অর্থনৈতিক স্বার্থ পাল্টে যায় বা তাতে সংঘাত বাধে, এবং শেষ পর্যন্ত তা মূল্যহীন হয়ে যায়। এই কারণেই পুরসভা বা রাজ্য স্তরের ভোটে প্রভাব থাকলেও অর্থনৈতিক বিষয়গুলি জাতীয় নির্বাচনে তত গুরুত্বপূর্ণ হয় না।
সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফলদায়ী কোনও কাজ করতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছিল নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে, যে তির তাঁকে লাগাতার সামলেও যেতে হয়েছে। এই যাত্রায় বিজেপি তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদীও ‘বিকাশ’কেই বিহারে এনডিএ-র প্রধান মন্ত্র হিসেবে প্রচার করেন। এবং, শুধুমাত্র অর্থনীতির কথা বলে রীতিমতো সফল হয়েছেন তেজস্বী যাদব।
আসলে, ভোটার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির ভূমিকা কমতে থাকে। এর থেকেই বোঝা যায়, লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা আর নগর পঞ্চায়েতে ভোটের ফল কেন এক রকম হয় না।
বাড়ি থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, অর্থনীতি ততই অর্থহীন হতে থাকে।