আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার জানাইল, দুনিয়াব্যাপী মন্দার ধাক্কা অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভারতের গায়ে প্রবলতর বেগে লাগিতে চলিয়াছে। ভারতে সেই বিপর্যয়ের অনিবার্যতার প্রমাণ প্রচুর। কোর সেক্টর, অর্থাৎ দেশের শিল্প উৎপাদনের প্রধানতম ক্ষেত্রগুলিতে গত বৎসরের তুলনায় এই বৎসরের অগস্টে উৎপাদন কমিয়া গিয়াছে। গত বৎসরের তুলনায় উৎপাদন কমিয়াছে ০.৫ শতাংশ। ২০১৫ সালের এপ্রিলের পর এমন অবস্থা আর কখনও হয় নাই। আটটি শিল্প লইয়া ভারতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রটি গঠিত। সেগুলি হইল: বিদ্যুৎ, ইস্পাত, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য, অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, কয়লা, সিমেন্ট, প্রাকৃতিক গ্যাস ও সার। শিল্প উৎপাদনের সূচকে শুধু এই আটটি ক্ষেত্রের গুরুত্বই ৪০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ, আর্থিক ভূমিকম্পের এপিসেন্টার এই দফায় একেবারে ভারতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে। লক্ষণীয়, এই আটটি শিল্পের মধ্যে যে পাঁচটিতে উৎপাদন হ্রাস পাইয়াছে, তাহার মধ্যে তিনটিতে জুলাই মাসেও উৎপাদন হ্রাস পাইয়াছিল। ক্ষেত্রগুলি হইল কয়লা, অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। বিদ্যুৎ এবং সিমেন্ট ক্ষেত্রে জুলাইয়ে উৎপাদন বাড়িয়াছিল, অগস্টে কমিয়াছে। এই ক্ষেত্রগুলির বৈশিষ্ট্য হইল, এগুলি অন্য শিল্পে উৎপাদনের উপাদান প্রস্তুত করে। যেমন, বিদ্যুতের উৎপাদন কমিবার পরও দেশের বাজারে বিদ্যুতের অভাব অনুভূত না হইবার অর্থ, চাহিদা কমিয়াছে। এবং, সেই চাহিদা গৃহস্থালির নহে, শিল্পক্ষেত্রের। অর্থনীতির বাকি ছবিগুলির সঙ্গে এই কথাটির সাযুজ্যও আছে বটে। গাড়ি হইতে বিস্কুট, সকল পণ্যেরই চাহিদা কমিতেছে, ফলে উৎপাদনও কমিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন নাই, ফলে বিদ্যুতেরও প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ, কোর সেক্টরে উৎপাদন হ্রাসের সাম্প্রতিক সংবাদটি প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় অর্থনীতির ভগ্নস্বাস্থ্যের ক্রমশ প্রকাশ্য ছবিটির অংশমাত্র। অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সম্ভবত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থমন্ত্রী সহ গোটা কেন্দ্রীয় সরকার যে বাস্তবটিকে প্রাণপণে অস্বীকার করিয়া চলিতেছেন, কোর সেক্টরের উৎপাদন হ্রাস আরও এক বার সেই কথাটিই মনে করাইয়া দিল।
এই আর্থিক গতিভঙ্গের আঁচ দরিদ্র শ্রেণির গণ্ডি টপকাইয়া ক্রমশ মধ্যবিত্তের গায়ে লাগিতেছে। তাহার প্রমাণ, ভারতের বাজারে ছোট গাড়ির— যাহাকে বলা হয় এন্ট্রি লেভেল প্যাসেঞ্জার কার— বিক্রি কমিয়াছে বিপুল হারে। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের নিকটই গাড়ি এখনও প্রয়োজন নহে, বিলাসিতা। ফলে, হয় মধ্যবিত্তের হাতে এই বিলাসিতার পিছনে ব্যয় করিবার মতো বাড়তি টাকার জোগান বন্ধ হইয়াছে, নয় হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভাবিয়া তাঁহারা বিলাসিতার পিছনে ব্যয় করিতে নারাজ। দুইটি সম্ভাবনাই গভীর দুঃসংবাদ। অটলবিহারী বাজপায়ীর ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’-র সাফল্যের পিছনে বৃহত্তম কারণ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পশ্চাদ্ধাবন করিবার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার ধাক্কাও ভারতের গায়ে ততখানি লাগে নাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার কল্যাণেই। এই দফায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইতিমধ্যেই কাবু, এবং ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন। ফলে, এই মন্দা ক্রমে গভীরতর হইবে, তেমন আশঙ্কা উড়াইয়া দেওয়ার সুযোগ নাই। দেশের এক প্রথম সারির শিল্পপতি কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ লইয়া মাথা না ঘামাইতে পরামর্শ দিতেছেন, ইহা সামান্য সংবাদ নহে। ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতিতেই যে দেশের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র কাবু হইয়াছে, এই কথাটি অনস্বীকার্য। কর্পোরেট করে ছাড় দিয়া সেই সমস্যার সমাধান হইবে না, শিল্পমহলই তাহা বুঝাইয়া দিতেছে। এক্ষণে প্রশ্ন, এই বাস্তব লইয়া অর্থমন্ত্রী কী করিবেন? জানাইবেন যে চিন্তার কিছু নাই— এত দিন যেমন জানাইতেছেন? না কি, সত্যই সমাধান খুঁজিবার চেষ্টা করিবেন?