ছবি: সুব্রত চৌধুরী
বৌয়ের চিঠি পড়তে পড়তে রাস্তায় হাঁটছিল লোকটা। ভিড় বাসে ঘাড়ের কাছে কৌতূহলী মুখটার জন্য ভাল করে পড়তে পারেনি। তাই বাস থেকে নেমে তর সইছে না! কিংবা এমনও হতে পারে চিঠিটা ইতিমধ্যেই কয়েক বার পড়া হয়ে গিয়েছে। তবু যেতে যেতে আর এক বার পড়ছে! পড়ে পড়ে আশ যে মেটে না! তাই বাড়ি ফেরার পথে আর এক বার পড়ছে। এইটুকু রাস্তা তার কাছে প্রায় স্বপ্নসরণি। এইটুকু সময় তার একান্ত নিজের।
আচ্ছা, ভাঁজ করে পড়া হাতের চিলতে চিঠিটুকুর বদলে, যদি একটা স্মার্টফোন থাকত তার হাতে! ও পারে, কি ধলেশ্বরী নদীতীরে সে আছে অপেক্ষা করে? কিংবা কে জানে, ভিন্ভাষী শহরে বা সাতসাগর পারের দেশে ছবির মতো বিশ্ববিদ্যালয় শহরে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কোনও নারী হয়তো তখন তার চ্যাটের জবাব দিচ্ছে!
কী কথা বলছে তারা এই দূরত্বের কাঁটা ভেদ করে? আবার কবে দেখা হবে, ফেরা হবে! না কি দেখাটা, ফেরাটার আদৌ কী মানে, হাতড়াচ্ছে তারা? জীবনে যা হল, হবে, কিংবা যা হওয়ার নয় ভাবতে ভাবতেই চিরপ্রবাসী অন্তরে প্রায় উইথড্রয়াল সিনড্রোমের ছটফটানি! এটাই আগমনি? এর মধ্যে এক ধরনের নেশাতুরের অসহায়তাও কি মিশে থাকে? অনেক সময়ে সেই ছটফটানিই সার! একটা সন্ধান। যার মধ্যে স্বপ্নপূরণের তুঙ্গবিন্দু নেই, ভোরের স্বপ্নের তাল-কাটা অস্বস্তির ফাঁকটাই বেশি।
আরও পড়ুন: নতুন হোক পুজো, নতুন হই আমরাও
বিয়ের আগে লোকটার নামমাত্র চাকরি, কিংবা তাও ছিল না। মাসান্তে বাড়িভাড়া মেটাতেও কালঘাম ছোটে। কিন্তু বাস থেকে নেমে কাঠের সাঁকোটায় উঠেই সব দুশ্চিন্তা ম্যাজিকের মতো গায়েব। সাঁকো থেকে রেল ইয়ার্ড, বস্তির গেরস্তালি, ভিড়, জটলা, ছোটদের কিতকিত কি গলি ক্রিকেটের পাশ দিয়ে সে তরতরিয়ে ধুলো উড়িয়ে হেঁটে চলেছে। এইটুকু রাস্তা সে রোজ হেঁটে ফেরে। আর ভাবে, যে আশ্চর্য উপন্যাসটা সে লিখছে, তার কথা! এক দিন সেই উপন্যাসটা শেষ হবে! লোকে ধন্য ধন্য করবে! হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনেই লোকটা রোজ চেঁচিয়ে ওঠে, তার উপন্যাসের মূল চরিত্রটার কথা ভেবে। ছেলেটা মহৎ কিছু হয়তো করছে না। তার দারিদ্রও কাটছে না। কিন্তু সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না। নিজের শর্তে মাথা উঁচু করে বাঁচছে। পালাতে চাইছে না। সে বাঁচতে চাইছে। হি ওয়ান্টস টু লিভ...
আরও পড়ুন: পুজোর ভিড়ে লুকিয়ে বিপদ
এখন সেই কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। নাছোড় আশার মধ্যে এক ধরনের আগমনি তো থাকেই! নানা কারণে একলাটি হাঁটতে হাঁটতে চিঠি-পড়া, চিঠি পড়তে পড়তে ভিড়ের মাঝেও আনমনে হেসে-ওঠা লোকটাকে ইদানীং বড্ড মনে পড়ছে। জীবনের নিত্য নিষ্ঠুর ঘা খেয়েও যে অমল হাসি কেউ কেড়ে নিতে পারে না। অনেক বার দেখা সিনেমার দৃশ্য হানা দিচ্ছে চোখের সামনে। লকডাউনের জড়তায় কত তরুণ হাসি শুকিয়ে গেল। দিশারি অভিভাবককে দিন দিন তিলে তিলে গুটিয়ে যেতে দেখার গ্লানিও ঘরে ঘরে সৌধের মতো ফুলেফেঁপে ওঠে। এ কোন অনিবার্যতার আগমনি! সকালের খবরের কাগজের বাঁ দিকের কলামে উৎসুক চোখ তবু খুঁজেছে পাখির ঠোঁটে তুলে নেওয়া জীবনের খড়কুটোর আশা। কোথায় পাব, গভীর অসুখের উজান ঠেলে বাঁচার লড়াইয়ের ছবি? উৎসবের আবহে আশার মধ্যে আশঙ্কার সুরও কি মিশে থাকে আগমনির ডাকে?
বাঙালির বহুবিশ্রুত এক রাজবাড়ির কর্তার কাছে শোনা তাঁদের দুর্গাদালানে সানাইওয়ালার গল্প মনে পড়ছে। তিনি তখন নিতান্তই খুদে। সানাইয়ের ধুন শুনতে শুনতে ঠাকুরদালানে আপনমনে নাচছেন। বড়রা কেউ এসে হঠাৎ ধমক, ‘‘আহ, এ কী বাজনা!’’ সানাইয়ের আর্তি করুণ সুরে বদলে যেতে ছটফটে শিশুটি মনমরা। এর সঙ্গে আর কী করে নাচ হবে। প্রবীণ গুরুজনটি তাকে সস্নেহে সান্ত্বনা দেন। ‘‘বড় হ’! তোর যখন মেয়ে হবে, তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় হলে বুঝবি এই সুরের মানে!’’
আগমনির সুর শুধুই নির্ভেজাল মিলনের আবাহন নয়। তাতে অনেক পরত মিশে থাকে এ তো জানা কথাই! উৎসবের রংচঙে ধড়াচুড়ো কোনও শাশ্বত সত্য নয়। বরং এক ছদ্মবেশ। একটা ঠাট্টা। স্বয়ং মণ্ডপের দেবীরও সেই ঠাট্টায় ছাড় নেই। আগমনি গান বলে, ‘অবস্থা তোর আছে জানা, ভাতের ওপর নুন জোটে না / তবে এত নবাবী কেন মা, প’রে বেনারসী-চেলি!’ তবু এ বার সেই গরমিল তীব্র ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সর্বজনীন শব্দটা অনেকটা ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’-এর মতোই।
সব পুজো, সবার পুজো কবেই বা সমান হয়েছে! পুজোর মোড়কে উমার আদলে ঘরের মেয়ের জন্য যতটা ব্যাকুল হয়েছি, ঘরের মেয়ের নিত্য নিষ্পেষণের রোজনামচা নিয়ে সচরাচর ভাবা হয়নি। তথাকথিত নিম্নবর্ণের অপাঙ্্ক্তেয় যে মেয়ের উপরে নির্যাতন, নিষ্ঠুর অবিচার নিয়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠল, তার জোর করে জ্বালানো চিতার ধোঁয়া ঠান্ডা না-হতেই উৎসবের গড্ডলিকায় দশভুজা আসছেন। খটকা লাগে, লাঞ্ছিতা নারীর জন্য যে চোখে অশ্রু ঝরে, সে-ই কি রাজারাজড়ার উপাস্য মহিষমর্দিনী ত্রিশূলধারিণীর টানেও সজল হয়? বোধন শেষে মণ্ডপের ওই মুখের আরশিতে কি সত্যি সব মেয়ের মুখ ফুটে ওঠে? উপচারের ঘটাপটা দেবীপক্ষ আবেগের মাখামাখিতে কত শত গিলে ফেলা কান্না, নিজেকে চোখ ঠারা ছলনাও মিশে থাকে।
তবু সোশ্যাল মিডিয়ার জমকালো মিম বলছে, বাঙালির কাছে শ্রেষ্ঠতম সুগন্ধির বিজ্ঞাপন হল পুজোর গন্ধ! কিন্তু সেই গন্ধটাও এ বার রীতিমতো সন্দেহজনক! এ গন্ধ যদি আপনি এখনও না-পেয়ে থাকেন, তা হলেও এ কোনও গোলমেলে উপসর্গ ভেবে রাতের ঘুমটা মাথায় উঠতেই পারে। কিন্তু সে গন্ধ তীব্রতর হলেও তাকে ঘিরে ঘোর আতঙ্কই তো ঘনিয়ে উঠছে। হাতে-গরম ওনাম-পরবর্তী কেরল, গণেশ উৎসব শেষের মহারাষ্ট্র বা রথযাত্রা-পরবর্তী পুরীর নামে চেতাবনি শুনে শুনে কান পচে গেল। উৎসবের পর রাতারাতি কোথায় কার সাড়ে সর্বনাশ ঘটল, দুর্গতিতে কে কার সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে, এই নিয়ে দিনভর ঘ্যানঘ্যানানি কচকচানি।
আর এক ধরনের আগমনির সুর বেজে ওঠে অতিমারির শিকার নিয়ে রোজকার হিসাব-নিকাশেও। এ ভাবেই কি বাড়বে আক্রান্তের সংখ্যা? এ দিকে, জীবন ডাকছে, শহরের ফুটপাতে, দোকানে, কয়েক মাস বাদে কুম্ভকর্ণের মতো জাগতে মরিয়া রেস্তরাঁ, পানশালা, সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্সে। সিডি-তে ঢাক বাজছে দোকানে, দোকানে। প্যান্ডেলের মাইক বলছে, করোনাকে লকডাউন করে খোলা হাওয়ায় সবারে করি আহ্বান...
কী হবে এই আনন্দের পরিণাম? মেনকা গেয়েছেন, কৈলাসে তোপসে-ইলিশ মাছ নেই, বায়োস্কোপ, থিয়েটারও অমিল। ‘এ বার আমার উমা এলে আর উমায় পাঠাবো না/ মা আমার কৈলাসেতে পায় না খেতে চিনেবাদাম ঘুগনিদানা...’ কিন্তু এখন খাবারের নাম শুনলে আগে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজ় করার কথা মনে পড়ে! মেনকা কি তবে উল্টে উমাকে আসতে বারণ করছেন? উৎসবের হাসি, আনন্দ কী করে থাকবে অ্যাসিম্পটমেটিক!
গ্রামান্তরের রাস্তায় এখন চুড়ো করে বাঁধা পাটকাঠি। বর্ষাশেষের রসস্থ প্রকৃতির কপালে কাশের রুপোলি রেখা! ঘরে ফিরতে চাওয়া যুবার দিকে সে প্রবীণ প্রেমিকের চোখে তাকায়। আগমনি মানে নিছকই জীবনের রোজনামচা থেকে ছুটি নয়, সেই ছেঁড়াখোঁড়া বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই উত্তরণের স্বপ্ন। ভাবতে ভাবতে বুঝতে বুঝতে চুলে পাক ধরল।
পুজোর আর একটা সিম্পটম, পুরনো কথা মনে পড়া! কোনও এক তরুণ অপুর অনাগতের দিকে হেঁটে চলার পথটুকু মনে হয় আগমনির সুর! জানা নেই, সে পথের শেষে কী! চার পাশে আর সব কিছু তো চিরকালের। তবে ক্লিশে হয়েও ক্লিশে হয় না। শীত শেষে বসন্তের অনুপ্রবেশের এপ্রিলকে নিষ্ঠুরতম মাস বলেছিলেন টি এস এলিয়ট। শীতের মৃতকল্প পৃথিবীর বরফ ফুঁড়ে কুসুমচিহ্নে যখন আর্তি ও স্মৃতির ছ্যাঁকা! আমাদের কপালে এই অভিঘাত বরাবর শারদ স্পর্শে। নিষ্ঠুরতম পুজোর পদধ্বনিতে বুকটা ছ্যাঁৎ করে! চলার পথে যদিও হংসধ্বনি...