বুলবুলে সুন্দরবন বিধ্বস্ত, কলকাতা চুপ

একই ছবি চিনাই নদীর ও-পারে, মূলত শুকনো মাছের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ফ্রেজারগঞ্জে। একটা মাছের আড়তও আস্ত নেই। কয়েক মাস আগেই দোকান, মানুষ, নৌকায় গমগম করা সমুদ্রপাড় এখন শুনশান।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০১:১২
Share:

গোটা চাষের জমিতে জল, ধানগাছ নুয়ে পড়া; পানের বরজ আস্ত নেই বললেই হয়। গাছ ভেঙে পড়েছে, ল্যাম্পপোস্ট হেলে পড়েছে।

মৌসুনি দ্বীপের ভাঙনপল্লি গ্রাম এমন ঝড় আর ভাঙন আগে কখনও দেখেনি। “আমার ৭৫ বছর বয়সে এমন ঝড় দেখিনি, মনে হচ্ছিল আয়লার থেকেও দ্বিগুণ গতিবেগে ধাক্কা মারছে”, বুলবুল ঝড়ের দাপটে ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন শেখ মন্তেজ আলি। কুসুমতলা মৌজার মধ্যে থাকা গ্রামটির প্রায় প্রতিটি মাটির বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় গোটা চাষের জমিতে জল, ধানগাছ নুয়ে পড়া; পানের বরজ আস্ত নেই বললেই হয়। গাছ ভেঙে পড়েছে, ল্যাম্পপোস্ট হেলে পড়েছে।

Advertisement

একই ছবি চিনাই নদীর ও-পারে, মূলত শুকনো মাছের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ফ্রেজারগঞ্জে। একটা মাছের আড়তও আস্ত নেই। কয়েক মাস আগেই দোকান, মানুষ, নৌকায় গমগম করা সমুদ্রপাড় এখন শুনশান। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গবাদি পশুর মৃতদেহ, ইট-কাঠ-সিমেন্ট, ভেঙে পড়া বাড়ির সারি। “প্রাথমিক হিসেব বলছে, সাগরে শুকনো মাছের ব্যবসায় ক্ষতি প্রায় ৫৩ কোটি, ফ্রেজারগঞ্জে তা ১০০ কোটি ছাড়াবে”, জানালেন দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী সংস্থার মিলন দাস। অন্তত পঞ্চাশ হাজার মৎস্যজীবী পরিবার গভীর সঙ্কটে। সুন্দরবনের মানুষ প্রধানত যে চারটে জিনিসের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন: ধান, পান, শাকসব্জি, মাছ— সবগুলোই বুলবুলের দাপটে প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত।

সুন্দরবন দফতরের মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরাও মানছেন যে বুলবুলের বিপর্যয় আয়লার তুলনায় বেশি; বিপুল ফসল তো বটেই, কত যে বিদ্যুতের পোল আর বাড়ি ভেঙেছে তার ইয়ত্তা নেই। রাজ্য সরকারও কেন্দ্রকে ক্ষয়ক্ষতির যে প্রাথমিক হিসেব দিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, আয়লার তুলনায় বুলবুলের ধাক্কা বেশি। এটাই হওয়ার কথা, কারণ বুলবুলের সর্বোচ্চ গতিবেগ আয়লার তুলনায় বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত, আয়লার গতিপথ দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী হলেও, বুলবুল সুন্দরবনের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর গোটা বাদাবনের মধ্যে দিয়ে আড়াআড়ি দৌড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে যেমন সুন্দরবন অন্তর্গত দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা, সাগর, নামখানা বা কাকদ্বীপ প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত; তেমনই ধরাশায়ী উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ। এই ক্ষতি বহু গুণ বাড়ত, যদি বুলবুল ধাক্কা দেওয়ার সময় নদীতে ভাটা না শুরু হয়ে যেত!

Advertisement

প্রশ্ন হল, সুন্দরবন এত ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হলেও, কলকাতা তথা বাকি রাজ্যের হেলদোল নেই কেন? কেন আয়লার সময় ত্রাণ দেওয়ার জন্য লাইন পড়ে গেলেও, এখনও কোনও কর্পোরেট বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বুলবুলের ক্ষতি সামলাতে এগিয়ে আসছে না? মনে হয়, দু’টি কারণে। আয়লার নাটকীয়তা অনেক বেশি ছিল, একের পর এক বাঁধ ভেঙে নদীর জল গ্রামে ঢুকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন করেছিল; জীবনহানিও হয়েছিল বেশ কিছু। তুলনায় জি প্লট ছাড়া, বুলবুলে খুব বেশি বাঁধ ভাঙেনি, জীবনহানিও কম। অন্য কারণটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। আয়লায় কলকাতা বড় রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তুলনায় বুলবুলে কিছুই হয়নি। আর কলকাতার কিছু হয়নি মানেই ‘তেমন কোনও বড় ব্যাপার নয়’ এই মানসিকতায়, বলা ভাল উন্নাসিকতায়, ভুগছে কলকাতা। এটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে যে, এখন অবধি কলকাতা তথা দক্ষিণবঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবল ধাক্কা সত্ত্বেও টিকে আছে, স্রেফ সুন্দরবনের দাক্ষিণ্যে। তাই সরকারের উচিত কলকাতা-সহ আশেপাশের পুরসভাগুলি থেকে ‘সুন্দরবন ট্যাক্স’ আদায় করে, তা সুন্দরবনের মানুষের জীবিকা ও পরিকাঠামো তৈরি ও শক্তিশালী করতে ব্যয় করা।

অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় সুন্দরবন যদি ক্রমেই আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যা কিনা বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তবে এর পিছনে টাকা নষ্ট করে লাভ কী? অনেক বিশেষজ্ঞ সুন্দরবন থেকে মানুষজনকে সরিয়ে আনতে সওয়াল করছেন, যাকে তাঁরা বলছেন ‘প্ল্যান্‌ড রিট্রিট’ বা পরিকল্পিত ভাবে পিছিয়ে আসা। বহু বছর আগেই কিছু মানুষ লোহাচরা বা ঘোড়ামারা থেকে সরেছেন। কিন্তু এ ভাবে গণহারে সরার দাওয়াই, জলবায়ু পরিবর্তনের অঙ্কে সহজ সমাধান হলেও, আজকের রাজনীতি, অর্থনীতি বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে দুরূহ ভাবনা। সুন্দরবন থেকে সরিয়ে কোথায় রাখবেন আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে? তবে কি একই যুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কার মাপকাঠিতে ২০৫০ সালে এশিয়ার এক নম্বর শহর হতে চলা কলকাতা থেকেও মানুষকে সরতে হবে? বা রাজস্থানের সেই সব অঞ্চল থেকে, যেখানে প্রতি বছর বহু মানুষ স্রেফ গরমে মারা যান? এই সরার শেষ কোথায়? সুন্দরবনের আশু প্রয়োজন পরিকল্পিত ভাবে পিছিয়ে আসার বদলে পরিকল্পিত পরিকাঠামোর— সবার জন্য শক্তপোক্ত বাড়ি, নোনা জলে চাষের সুলুক সন্ধান, নতুন প্রজন্মের জন্য চাষবাস মাছধরার পাশাপাশি অন্য জীবিকার বন্দোবস্ত, ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙন সামলানোর জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি, বিমার মতো ব্যবস্থা। এক সময় দেওয়াল লিখন হত, বস্তির উন্নয়ন হোক বস্তি রেখেই। আয়লা বা বুলবুলদের হাত থেকে সুন্দরবনকেও বাঁচাতে হবে সুন্দরবনকে রেখেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement