স্বচ্ছ ভারত গড়িতে সাড়ে নয় কোটি শৌচাগার তৈরি হইয়াছে। এখন খোঁজ পড়িয়াছে, সেগুলি সাফ করিবে কে? পানীয় জল ও শৌচাগারের বিষয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট প্রশ্নটি ফের তুলিল। ভারতে মাত্র সতেরো শতাংশ শৌচাগার পাইপবাহিত নিকাশি ব্যবস্থার সহিত যুক্ত। গ্রাম ও শহর মিলাইয়া প্রায় সত্তর শতাংশ গৃহস্থালি এমন শৌচাগার ব্যবহার করিতেছে, যাহার ভূগর্ভ-স্থিত আধার পরিষ্কার করিবার উপায় যন্ত্র অথবা মানুষ। বড় বড় শহরেও বহু বসতবাড়ি, কারখানার সেপটিক ট্যাঙ্ক, এমনকি নিকাশি নালাও সাফ করিতে ভরসা সাফাই কর্মীরা। বিপজ্জনক এই কাজে গত পঁচিশ বৎসরে ছয়শোরও অধিক কর্মী নিহত হইয়াছেন। মানববর্জ্য সাফ করিতে মানুষের নিয়োগ বেআইনি হইয়াছে বহু পূর্বে, তবু কয়েক লক্ষ মানুষ এই কাজ করিতেছেন। আইন অনুসারে, যে সকল শৌচাগার উন্নত উপায়ে পরিষ্কৃত হইবার উপযোগী নহে, সেগুলিকে চিহ্নিত করিয়া ভাঙিয়া ফেলিবার দায় প্রশাসনের। অথচ প্রশাসনই ‘অভিযান’ চালাইবার নামে এমন শৌচাগার গড়িতেছে। আশঙ্কা, ইহার ফলে মানববর্জ্য সাফ করিবার কাজটি পরবর্তী প্রজন্মেও বাহিত হইবে। যে হেতু এই কাজে দলিত এবং মহিলাদের নিয়োগই সর্বাধিক, তাই তাঁহাদের সামাজিক অমর্যাদার অবসান ঘটিবে না। অপর উদ্বেগ, পরিষ্কৃত বর্জ্য ফেলা হইবে কোথায়?
প্রশ্নগুলি গত কয়েক বৎসর ধরিয়াই বিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীরা তুলিতেছেন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট দেখাইল, উদ্বেগের কারণ যথেষ্ট। সরকার অবশ্য যে কোনও প্রশ্নের মোকাবিলা করিবার একটিই উপায় জানে— তাহা উড়াইয়া দেওয়া। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা দাবি করিয়াছেন, সরকারি অনুদানে নির্মিত সকল শৌচাগার স্বাস্থ্যসম্মত। সরকারি পরামর্শে গঠিত শৌচাগার সঞ্চিত বর্জ্যকে সারে পরিণত করে, সাফ করিবার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অনুসারে, তাহার ব্যবহার মাত্র সাত শতাংশ। উত্তরপ্রদেশে একটি সমীক্ষা দেখাইয়াছে, সাতাশি শতাংশ ক্ষেত্রে শৌচাগারে সঞ্চিত বর্জ্য মিশিতেছে পুকুরে বা খেতে। বিষয়টি জাতীয় সঙ্কটে পরিণত হইতেছে। কেন্দ্রীয় দূষণ পরিষদের তথ্য অনুসারে, ভারতের নদীগুলিতে অন্তত ৩৫১টি এমন অংশ রহিয়াছে যাহার দূষণের স্তর ‘সঙ্কটপূর্ণ’, প্রধানত কাঁচা বর্জ্য মিশিবার কারণে। ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে নদীতীরে বর্জ্য সংস্কারের ব্যবস্থা গড়িবার কথা ছিল। কাজ সামান্যই হইয়াছে। তৎসহ, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মিত শৌচাগারের বর্জ্য ভূগর্ভস্থ জলকেও দূষিত করিতেছে।
‘স্বচ্ছতা’-র সরকারি সংজ্ঞা উন্মুক্ত শৌচের অবসানের সহিত নিরাপদ উপায়ে বর্জ্যের অপসারণ, ঘর ঘর হইতে আবর্জনা সংগ্রহ ইত্যাদির কথাও বলে। সে সকল লক্ষ্য সরকার ভুলিয়াছে। এমন অপরিণামদর্শিতা সরকারের নিকট অপ্রত্যাশিত নহে। বহু প্রকল্পই বিস্তারিত পরিকল্পনায় শুরু হইয়া একটি বা দুইটি ‘লক্ষ্য’-তে আটকাইয়া যায়। যে ফলগুলি সহজে দৃশ্যমান হয়, সেইগুলিতে সীমাবদ্ধ হইতে চাহে। তাহার মূল্য চুকাইতে হয় দেশকে। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের ব্যয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিজ্ঞাপন। কারণ, কাজ যত না গুরুত্বপূর্ণ, ‘কাজ হইতেছে’ সেই কথাটি ঘোষণা করা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, স্বচ্ছ ভারতের বর্জ্য দলিতেরা বহিবেন, তাহার বিষ নদী-নালার জলে মিশিবে— ইহাই ভবিতব্য।