ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার কথা বলেন

এই লোভ ঠেকাব কী করে

ট্রাম্পের কথাটা যে নেহাত ইয়ার্কি নয়, অথবা রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ীর আদিম রিপুর প্রকাশও নয়, গ্রিনল্যান্ডকে দখল করার বাসনাটি রীতিমতো ভূ-রাজনীতি আর অর্থনীতির যুক্তি মেনে চলে, এটা মনে করার বিস্তর কারণ আছে।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৯ ২৩:২৭
Share:

ভাসমান: হিমবাহ গলে ভেসে চলেছে সাগরের দিকে। গ্রিনল্যান্ডের কুলুসুক শহরের কাছে। ১৬ অগস্ট, ২০১৯। এপি

গ্রিনল্যান্ডকে কিনে নিলে কেমন হয়?’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই কথাটাকে ইয়ার্কি অথবা ট্রাম্পসুলভ বাচালতা ভেবে উড়িয়ে দিলে ল্যাঠা চুকে যেত। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন অবশ্য এত হালকা ভাবে নেননি কথাটাকে। তিনি সপাট জানিয়েছেন, গ্রিনল্যান্ডে এসে ব্যবসা করতে চাইলে স্বাগত, কিন্তু কেনাকাটার বাসনা ভুলে যাওয়াই ভাল। মেরুবৃত্তের অন্তর্গত বিশ্বের বৃহত্তম এই দ্বীপটি এখনও ডেনমার্কের অধীন, কিন্তু গত চল্লিশ বছর ধরে স্বশাসিত। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় আবার বিস্তর চটলেন ট্রাম্প। যে কোনও মহিলাকে অপছন্দ হলেই যে বিশেষণটি প্রয়োগ করে থাকেন তিনি, ফ্রেডেরিকসেনকেও বললেন সেটাই— ‘ন্যাস্টি’। এবং, সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত ডেনমার্ক সফর বাতিল করে দিলেন। গাল পাড়লেন ‘নেটো’-কেও। একটি আপাত-তুচ্ছ মন্তব্য থেকে কার্যত কূটনৈতিক সঙ্কটে পৌঁছতে সময় লাগল মাত্র কয়েকটা দিন।

Advertisement

ট্রাম্পের কথাটা যে নেহাত ইয়ার্কি নয়, অথবা রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ীর আদিম রিপুর প্রকাশও নয়, গ্রিনল্যান্ডকে দখল করার বাসনাটি রীতিমতো ভূ-রাজনীতি আর অর্থনীতির যুক্তি মেনে চলে, এটা মনে করার বিস্তর কারণ আছে। আট লক্ষ বর্গমাইলেরও বেশি বিস্তৃত, আর বহুলাংশে বরফে ঢাকা গ্রিনল্যান্ড, বস্তুত গোটা মেরুবৃত্তকে নিয়ে এখন অনেক দেশের আগ্রহ। তার মধ্যে রাশিয়া আছে— সে দেশের উত্তর সীমান্ত মেরুবৃত্তের মধ্যেই পড়ে। মেরুবৃত্তে সাতাশটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে রাশিয়া। আবার, চিনও আছে— মেরুবৃত্তের কাছাকাছি না থেকেও যারা নিজেদের মেরুশক্তি বলে প্রমাণ করতে মরিয়া। গ্রিনল্যান্ডে বিপুল বিনিয়োগ করতে আগ্রহী চিন। বিমানবন্দর থেকে খনি, সবেতেই পয়সা ঢালতে তারা উদ্গ্রীব। আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ায় যেমন শুধু বিপুল বিনিয়োগের জোরেই একের পর এক দেশে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করছে চিন, গ্রিনল্যান্ডের ক্ষেত্রেও সেই নীতি ঘোরতর স্পষ্ট। আর আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনীর সেকেন্ড ফ্লিট তৈরি হয়েছিল উত্তর অতলান্তিকের নিরাপত্তারক্ষায়। ২০১১ সালে ওবামার প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছিল সেই সেকেন্ড ফ্লিট। গত বছর ট্রাম্প ফিরিয়ে এনেছেন সেই নৌবহর, মেরুবৃত্তে নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে। উত্তর মেরুবৃত্তে নিজেদের উপস্থিতি পোক্ত করার প্রতিযোগিতা জোরদার।

কেন এই প্রবল তৎপরতা, মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেয়ো যেমন সেটা স্পষ্ট করে বলেছেন, চিনও বলেছে। পম্পেয়ো জানিয়েছেন, বিশ শতকের গোড়ায় যেমন সুয়েজ খাল কমিয়ে দিয়েছিল বাণিজ্যিক নৌ-পরিবহণের সময়, উত্তর মেরুবৃত্তে বরফ গলে জাহাজ যাওয়ার রাস্তা তৈরি হওয়ায় একুশ শতকে আবার তেমন একটা সুযোগ এসেছে। এই পথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এশিয়ায় পণ্য নিয়ে যেতে সময় বাঁচবে দু’সপ্তাহেরও বেশি। চিন এই পথের নাম দিয়েছে ‘পোলার সিল্ক রুট’। তবে শুধু নৌ-পরিবহণের পথ নয়, শুধু সামরিক প্রয়োজনের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান নয়, উত্তর মেরুর অসীম গুরুত্ব তার মাটির নীচে। বলা ভাল, বরফের নীচে। বিপুল খনিজ সম্পদ রয়েছে সেখানে। এত দিন তা মানুষের— বস্তুত পুঁজিবাদের, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার— নাগালের বাইরে ছিল, কারণ তার ওপর জমে থাকা বরফের আস্তরণ গলত না কখনও। বিশ্ব-উষ্ণায়নের কল্যাণে উত্তর মেরু গলছে। বছরে অন্তত পাঁচ মাস বরফ থাকছে না তেমন। বরফ গলে যেমন তৈরি হচ্ছে নৌ-পরিবহণের পথ, ঠিক তেমনই হাতে আসছে এত দিনের অধরা সম্পদ। গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আগ্রহ বাড়বে, তাতে আর সন্দেহ কী?

Advertisement

এখানে এসে এক বার থমকে দাঁড়াতে হয়। মানুষের অপরিণামদর্শিতা বিশ্ব-উষ্ণায়ন নামক যে মহাবিপদ ডেকে এনেছে, সেটাই তবে তৈরি করে দিচ্ছে নতুন সমৃদ্ধির সুযোগ? পুঁজিবাদ তো এ ভাবেই চলে— নতুন (প্রাকৃতিক) সম্পদের সন্ধান পেলে ছলে বলে কৌশলে সেখানে উপনিবেশ তৈরি করা, আর সেই সম্পদকে নিয়ে আসা বিশ্ব বাণিজ্যের বাজারে। যখন এত রাখঢাক ছিল না, তখন সরাসরি দখল করে নেওয়া যেত দেশগুলোকে। এখন দোহাই দিতে হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, অথবা পরিকাঠামো তৈরির। অথবা, আর্থিক উন্নয়নের— ব্রাজিলে যেমন বোলসোনারো আমাজনের আগুনে ‘উন্নয়নের সুযোগ’ দেখছেন। উত্তর মেরুবৃত্ত তবে সেই আদি অকৃত্রিম পুঁজিবাদী সম্প্রসারণই দেখছে?

হ্যাঁ, এবং না। হ্যাঁ, কারণ এত দিন যাবৎ যা হয়েছে, উত্তর মেরুবৃত্তে পুঁজিবাদ ঠিক সেটাই করছে। না, কারণ উত্তর মেরুবৃত্তে পুঁজিবাদী সম্প্রসারণের ফল যত মারাত্মক হবে, দুনিয়ার কোথাও কখনও তা হয়নি। কোনও বিপদের কথা এত সুস্পষ্ট ভাবে জানা থাকার পরও সেই কাজটিতে অবিচল থাকার ঘটনাও আগে কখনও ঘটেনি। বিপদ কিন্তু শুধু মেরুবৃত্তের নয়, গোটা দুনিয়ার। এবং, সেই বিপদের নাম বিশ্ব-উষ্ণায়ন। যে বিশ্ব-উষ্ণায়ন উত্তর মেরুবৃত্তের দরজা খুলে দিয়েছে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের জন্য, সেই বাণিজ্য বহু গুণে বাড়িয়ে তুলবে বিশ্ব-উষ্ণায়নের বিপদ। পরিবেশ বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাই ফিডব্যাক এফেক্ট।

উত্তর মেরুবৃত্তে হিমবাহ গলছে। আর, তাতেই ফুলে উঠছে গোটা দুনিয়ার সমুদ্রতল। বহু দ্বীপ হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই তলিয়ে যাবে সমুদ্রে, বহু মানুষ প্রাণ হারাবেন বা উদ্বাস্তু হবেন। হিমবাহের গলন নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। তার মধ্যে একটা হল হিমবাহের ভিতরের ছিদ্র বেয়ে জল তার তলদেশে পৌঁছে যেতে পারে কি না। পারলে, হিমবাহের গলন দ্রুততর হয়। আর, জল যত উষ্ণ হয়, ততই নীচে পৌঁছয় বরফের ছিদ্র গলে। আবার, বরফের আস্তরণ ঢাকা থাকলে সূর্যের তাপের সিংহভাগ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় মহাশূন্যে। বরফ গলে জল আর মাটি বেরিয়ে গেলে অনেক বেশি তাপ শোষিত হয়, ফলে মাটির উষ্ণতা বাড়ে। আর, তাতে বাড়ে বরফ গলার হারও। এর নাম অ্যালবেডো এফেক্ট। কেমব্রিজের সমুদ্রবিশারদ পিটার ওয়াডহামস হিসেব কষে জানিয়েছেন, বিশ্বের মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা ২৫ শতাংশ বাড়লে বিশ্ব-উষ্ণায়ন যতখানি বাড়ত, উত্তর মেরুবৃত্তে মাটির তাপমাত্রা বাড়ার ফলে সেই হার ততখানি বাড়ছে। তার পাশাপাশি আছে মেরুবৃত্তের মাটিতে জমে থাকা বিপুল মিথেন-ভাণ্ডারের মুখ খুলে যাওয়ার প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনা। গ্রিনহাউজ় গ্যাস হিসেবে মারাত্মক মিথেন। এই ভাণ্ডার খুলে গেলে উষ্ণায়নের গতি বাড়বে অনেক। এবং, চিন-আমেরিকা মেরুবৃত্তে যা করতে চায়, তার অর্ধেকও যদি করে ফেলতে পারে, তবে এই সম্ভাবনাগুলোর সব ক’টা একসঙ্গে সত্যি হবে।

এই কথাগুলো যখন আপনি-আমিও জানি, মার্কিন বা চিনা পুঁজিবাদের কর্তারাও বিলক্ষণ জানেন। ঠিক যেমন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টও জানেন, আমাজন বৃষ্টি-অরণ্য ধ্বংস হয়ে গেলে দুনিয়ার পরিবেশে তার কী মারাত্মক প্রভাব পড়বে। জেনেও তাঁরা মেরুবৃত্তে খনিজের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করতে চান, বৃষ্টি-অরণ্যের জমি তুলে দিতে চান শিল্পপতিদের হাতে। পুঁজিবাদের এত দিনকার ইতিহাসের থেকে এ বারের গল্প ঠিক এখানেই আলাদা। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে এক্সটার্নালিটি বলে— বাংলায় বলে অতিক্রিয়া— অর্থাৎ, কোনও একটি অর্থনৈতিক কাণ্ডের ফলে ঘটা অন্য ক্ষয়ক্ষতি, শিল্পবিপ্লবের দিন থেকেই তা পুঁজির সঙ্গী। কিন্তু, এটা অস্বীকার করা অন্যায় হবে বহু দিন অবধি সেই অতিক্রিয়ার কথা না জেনেই পুঁজি এগিয়েছে। ক্ষতি হবে, সেটা না জেনেই ক্ষতি করেছে পরিবেশের, দুনিয়ার। অথবা যখন ক্ষতির কথা জেনেছে, তার সঙ্গে এটাও জেনেছে যে সেই ক্ষতি হবে দূরতর কোনও ভবিষ্যতে। যার দায় এখনই বইতে হবে না কাউকে।

এখন এই কথাগুলো বলার উপায় নেই। বিশ্ব-উষ্ণায়নের বিপদ এখন শুধু জানা নয়, একেবারে প্রত্যক্ষ। ধ্বংস আক্ষরিক অর্থেই কয়েক দশকের দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সেই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে উত্তর মেরুবৃত্ত বা আমাজনের বৃষ্টি-অরণ্যের দখল নেওয়ার ঔদ্ধত্য পুঁজিবাদের ইতিহাসেও অ-পূর্ব। পুঁজিবাদের লোভ বলবেন একে? কার্ল মার্ক্স দ্বিমত হতেন। বলতেন, ঠিক এই ভাবে চলা ছাড়া পুঁজিবাদের আর উপায়মাত্র নেই। যার ‘লোভ’ থাকবে না, সে ছিটকে যাবে গোটা ব্যবস্থা থেকে। অন্য কেউ এসে তার শূন্যস্থান পূরণ করে দেবে।

কী ভাবে ঠেকানো যায় এই আগ্রাসনকে? পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে তার উত্তর মিলবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিকল্প পথ ভাবার জন্য অবশ্য সময়ও আর খুব বেশি পড়ে নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement