ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদী।
শান্তি, শান্তি, গণতন্ত্র, সহযোগিতা, পরমাণু চুক্তি, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, ২৬ জানুয়ারির প্যারেড ও পরমাণু চুক্তি।— আজ অবধি সাত জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আট বার ভারতে এসেছেন (বারাক ওবামা এসেছেন দু’বার), এগুলি তাঁদের আগমনের পোশাকি কারণ। এ বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের শুরুতেই ছিল ছন্দপতন। সফর ঘোষণার পরেই ট্রাম্প পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তাঁর সফরে বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের কোনও সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘ কাল ধরে দু’পক্ষের আমলারাই এর জন্য অন্য পক্ষকে দায়ী করে আসছিলেন, বলা হচ্ছিল, অন্য প্রান্তে যথেষ্ট সদিচ্ছার অভাব। ট্রাম্প বহু বার ভারতকে ‘মাসুলের রাজা’ আখ্যা দিয়েছেন। এর কারণ ভারতের পণ্য মাসুলের কাঠামো ও বাণিজ্য ঘাটতি। ট্রাম্পের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে সহজ স্বাভাবিক ভাবে ভারতের বাজারে ঢুকতে দিচ্ছে না। যদিও
পরে খানিকটা সান্ত্বনা পুরস্কার ঘোষণার মতোই ট্রাম্প বলেন, ভারতে এসে তিনি অনেক ‘কাজের কথা’ বলবেন।
এই ‘কাজের কথা’র আগে একটু ‘বাণিজ্য ঘাটতি’র ব্যাপারটা বুঝে নিলে মন্দ হবে না। আমদানি ও রফতানির মধ্যে মূল্যের ফারাকই হল ‘বাণিজ্য ঘাটতি’ বা ‘ট্রেড ডেফিসিট’। আরও সহজ করে বললে, এ হল বাকিতে দেওয়ার সুবিধে। আমদানির পরিমাণ রফতানির থেকে যত বেশি হবে, বাণিজ্য ঘাটতিও হবে তত বেশি। মনে রাখা দরকার, যে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার এই বাণিজ্য ঘাটতির সম্পর্ক, তাদের প্রথম দশের মধ্যেও কিন্তু ভারত নেই। আয়ারল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার, আর চিনের সঙ্গে সেই অঙ্কটা ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার!
আমেরিকার বাণিজ্যিক মানচিত্রে ভারত ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে? ভারতে মোবাইলে ডেটা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮০ কোটি। ফেসবুক, গুগল ইত্যাদি মার্কিন কোম্পানি ভারত থেকে এই মুহূর্তে বিপুল অর্থ রোজগার করছে। আগামী দিনে এ পথে আরও বেশি মুনাফার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে আরও অনেক মার্কিন কোম্পানি। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় আছে বড়সড় মতানৈক্যও। ট্রাম্প সরকার চায় আমেরিকার দুগ্ধ ও কৃষিজাত সামগ্রী সহজে ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। ভারতে ওষুধ বা স্টেন্ট জাতীয় জিনিসের মূল্য নিয়ন্ত্রণের যে নীতি, তাও মার্কিন সরকারের পছন্দ নয়। ভারতে তৈরি ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রীর ওপরে আমেরিকা কড়া মাসুল চাপিয়েছে। ভারতও জবাব দিয়েছে আমেরিকা থেকে আসা ২৯টি পণ্যের উপর মাসুল বাড়িয়ে। ২০১৯-এ আমেরিকা ভারতের ‘জেনারালাইজ়ড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস’ (জিএসপি) বাতিল করেছে। ফলে ভারতের ৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রফতানি— যার উপর ডিউটি লাগত না— এসে পড়েছে মাসুলের তালিকায়। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মার্কিন বাণিজ্যগোষ্ঠীকে লাভজনক ভাবে অনেক বাজারে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ভারত।
এ দেশে আসার ঠিক আগে ট্রাম্প আর একটি চাল চেলেছেন। বলেছেন, ভারত এখন আর উন্নয়নশীল নয়, উন্নত দেশ! এ রকম বলার কারণ, তিনি বুঝিয়ে দিতে চান, ভারত উন্নত দেশ বলে তাকে তিনি বিশেষ সুযোগ-সুবিধে দেবেন না।
ট্রাম্প এসে বললেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিশেষ বন্ধু। আদতে তিনি কী করলেন? ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমরাস্ত্র বেচলেন, দুই দেশের বাণিজ্য-বৈরিতার অবসানের পথে কিন্তু একটুও হাঁটলেন না। মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেন (শুধু মৌলবাদ বললে কী অসুবিধে ছিল?)। মোদীকে এনআরসি নিয়ে হালকা খোঁচা দিলেন। আবার আমদাবাদে এও বললেন, সীমা সুরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত রাখার অধিকার সব দেশেরই আছে। অবশ্য এ নিয়ে বেশি কিছু বলা তাঁর সাজে না, ট্রাম্প জানেন। সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে মুসলমানপ্রধান বহু দেশের নাগরিকদের মার্কিন ভিসা বন্ধ করেছেন তিনি। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সাংবাদিকেরা উত্তর পেলেন, এটা ভারতের নিজের ব্যাপার। কাশ্মীর নিয়ে বললেন, এটা ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেরই কাঁটা, কিন্তু দু’জনের কথাই শুনতে হবে।
অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া ভারতের প্রতি ট্রাম্পের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের বিশেষ পরিচয় পাওয়া গেল না। তা হলে প্রশ্ন, ট্রাম্প এলেন কেন? সোনার বাটিতে ভারতীয় খাবারে রসনাতৃপ্তি করতে বা ‘৭০ লক্ষ’ লোকের সামনে ভাষণ দিতে নয়। তিনি এসেছেন মোদীকে বুঝিয়ে দিতে, মানে মানে বাণিজ্যিক বৈরিতা তুলে নিতে। ফ্রান্স, রাশিয়া বা চিন ছেড়ে ভারত আমেরিকার কাছ থেকেই অস্ত্র কিনুক। বিনিময়ে সমর্থন পাবেন মোদী। ট্রাম্প ভারতের বন্ধু না হোন, মোদীর বন্ধু হয়ে উঠবেন।
আর ২০২০-র শেষে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গত বার মাত্র ১৬% ভারতীয় ‘মার্কিন’ ভোটার তাঁকে ভোট দিয়েছেন। সেই অঙ্কটা যদি ৮০ বা ৯০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া যায়, তা হলে বাণিজ্য অর্থনীতি রাজনীতি মিলে ভারত সফর হয়ে দাঁড়াবে ট্রাম্পের তুরুপের তাস, ‘ট্রাম্প’ কার্ড!