তুই তো মুসলিম। তুই পাকিস্তানি।’ রাজধানী দিল্লির পুসা রোডের নামজাদা স্কুল। এক বার ছেলেমেয়েকে এই স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে বাবা-মা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বোধ করেন। সেই স্কুলের ক্লাস টু-এর ছোট্ট মেয়ে গুরলিন চোপড়া তার সহপাঠী জুনেদ সিদ্দিকিকে বলেছে, ‘তুই তো মুসলিম। তুই তো পাকিস্তানি।’
নামগুলি পরিবর্তিত। ঘটনাটা সত্যি। জুনেদের বাবা-মায়ের নালিশ শুনে ক্লাসটিচারকে নির্দেশ দিতে হয়েছে, ‘স্কুলের মধ্যে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা চলবে না।’ কিন্তু স্কুলের বাইরে? দিল্লি থেকে শীত বিদায় নিচ্ছে। ভোটের আবহ ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। গুরলিন-জুনেদদের ক্লাসেও তার আঁচ পড়েছে।
নির্বাচনে কী কী প্রশ্নে লড়াই হওয়া উচিত? ‘‘এক, উন্নয়ন। দুই, সকলের জন্য উন্নয়ন। তিন, সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন।’’ গত মে মাসে লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, নতুন প্রজন্ম নতুন যুগের উন্নয়নের কর্মসূচি দেখতে চায়। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিজেপি সরকার কেন্দ্রে এমন উন্নয়নের কাজ করছে, যে বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলিকেও পাল্লা দিয়ে উন্নয়নের কাজ করতে হবে। আগামী দিনে তাই উন্নয়নের নিরিখেই ভোট হবে। বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলে প্রধানমন্ত্রী সে দিন বলেছিলেন, “যাদের হাতে কোনও উন্নয়নের পরিকল্পনা নেই, তারাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে”।
কারও দিকে তর্জনী তুললে হাতের তিনটি আঙুল নিজের দিকেই ঘুরে যায়। কথাটা ক্লিশে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিদারুণ ভাবে সত্য।
দিল্লির গদিতে মোদী সরকার ফের ক্ষমতায় ফিরেছে। এ বার দিল্লিতে বিধানসভা ভোটের লড়াই। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে জিতে দিল্লিতে পা রাখার প্রথম ধাক্কা ছিল এই দিল্লির বিধানসভা ভোট। বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি, হ্যাঁ, তিনটিই আসন পেয়েছিল বিজেপি। এ বার লোকসভা ভোটে ফের ক্ষমতায় ফিরেছে বিজেপি। দিল্লির ৭টির মধ্যে ৭টি লোকসভা আসনেই জিতে। কিন্তু বিধানসভায় বিজেপিকে ফের কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। নরেন্দ্র মোদীর চ্যালেঞ্জ লুফে নিয়ে তিনি ভোট লড়ছেন পুরোপুরি উন্নয়নকে হাতিয়ার করে। বলা ভাল, সকলের জন্য উন্নয়নকে সামনে রেখে।
গত পাঁচ বছরে দিল্লির সরকারি স্কুলের ভোল বদলে গিয়েছে। শুধু নতুন বাড়ি, ‘স্মার্ট’ ক্লাসরুম নয়, সরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা বোর্ডের পরীক্ষাতেও ভাল ফল করছে। মহল্লায় মহল্লায় আম আদমি ক্লিনিক খুলেছে। গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কাজকে প্রচারের অস্ত্র করেই কেজরীবাল ভোটে নেমেছেন।
আর বিজেপি নেতৃত্ব? তাঁদের একটাই প্রতিশ্রুতি। ভোটে জিতে এলেই শাহিন বাগের অবরোধ তুলে দেবেন। শাহিন বাগের মানুষের ‘পোশাক’ দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে, কারা সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। তাই তাঁদের তুলে দেওয়ার হুমকি দিলে অনেক বার্তাই পৌঁছে দেওয়া যায়। অমিত শাহ নালিশ করছেন, শাহিন বাগের মহিলারা নাকি ‘জিন্নাওয়ালি আজাদি’-র স্লোগান তুলছেন। উত্তরপ্রদেশ থেকে উড়ে এসে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ শাহিন বাগের সামনে জনসভায় ৪৮ সেকেন্ডে ৮ বার পাকিস্তানের নাম করেছেন। পাকিস্তান নাকি দিল্লির ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করতে চাইছে। গুজরাতের বিধানসভা ভোটে হারের আশঙ্কা দেখে শেষবেলায় নরেন্দ্র মোদী একই তাস খেলেছিলেন। অনুরাগ সিংহ ঠাকুর-প্রবেশ সিংহ বর্মার মতো ছোটখাটো নেতাদের কথা না-হয় বাদই রইল। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিযোগ তুলেছেন, শাহিন বাগের আন্দোলনের পিছনে দেশ বিভাজনের রাজনীতির নকশা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বা তাঁর সরকার কেন এ সব চলতে দিচ্ছে? দিল্লির পুলিশ অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের কাঁধে। যে কোনও সময় চাইলেই দিল্লির পুলিশ শাহিন বাগের আন্দোলন তুলে দিতে পারত। কেন সেখানে ‘দেশ বিভাজনের নকশা’ তৈরির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে?
কেননা, না হলে ভোটের ময়দানে শাহিন বাগের ‘জুজু’ দেখানো যেত না। মোদীর কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দরকার। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। কেজরীবাল তাঁর স্কুলের ভোল বদলের কথা বলছেন। তাঁর বিরোধীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিদ্বেষ সেই স্কুলের পাঁচিল ভেদ করে পড়ুয়াদের মনে ঢুকে পড়ছে। তাদের সরল মনে ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, মুসলিম মানেই পাকিস্তানি। পাকিস্তানি মানেই ভারতের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী।
অরবিন্দ কেজরীবালের উন্নয়নের রাজনীতিই যে বিজেপিকে চাপে ফেলে দিয়েছে, এমনটা নয়। গত এক বছর ধরেই দেশের রাজনীতিতে এক অদ্ভূত প্রবণতা তৈরি হয়েছে। একই ভোটার লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন, কিন্তু বিধানসভা ভোটে অন্য বোতাম টিপছেন। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড একই ছবি। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ওড়িশা। ২০১৯-এ একই সঙ্গে ওড়িশায় লোকসভা ও বিধানসভায় ভোট হয়েছে। একই ভোটার কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীকে ভোট দিয়েছেন, রাজ্যে নবীন পট্টনায়েককে।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এই প্রবণতা ধরে ফেলেছেন। তাই জাতীয় রাজনীতির যাবতীয় বিতর্ক, তা সে সিএএ হোক বা এনআরসি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ হোক বা শাহিন বাগ, নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে শাহিন বাগের অবরোধে মদতের অভিযোগ তুলছে। কেজরীবাল নিজের অবস্থানটুকু জানিয়েই মুচকি হেসে মহিলাদের নিরাপত্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন। রাজ্যের বিধানসভা ভোটের লড়াই তিনি রাজ্যের বিষয়েই রাখতে চান। তিনি জানেন, জাতীয় রাজনীতিতে ঢুকলেই নরেন্দ্র মোদী লোকসভা ভোটে দিল্লিতে সাতে সাত-এর মতো বিধানসভাতেও সত্তরে সত্তর করে ফেলার চেষ্টা করবেন।
উল্টো দিকে নরেন্দ্র মোদী দিল্লির ভোটকেও জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে আসতে চাইছেন। বিজেপি দিল্লির কোনও নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করেনি। শুধুই নরেন্দ্র মোদীর মুখ। দিল্লির সচিবালয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে যে-ই বসুন, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে মোদীই দিল্লির উন্নয়নের দেখভাল করবেন— এটাই বার্তা। কিন্তু বিজেপির ছোট-বড় নেতারা মাঠে নেমে সে প্রসঙ্গেই যাচ্ছেন না। শাহিন বাগ ও জামিয়ার আন্দোলনের বিরুদ্ধে দিল্লির বাকি মানুষের ক্ষোভ উস্কে দিতে তাঁরা বলছেন, সংখ্যাগুরুরা মুখ বুজে সব দেখছেন। ভোটের বাক্সে তাঁরা জবাব দেবেন। লড়াইটা যেন আম আদমি পার্টির সঙ্গে বিজেপির নয়। সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংখ্যাগুরুদের। যাঁদের পোশাক দেখেই চেনা যায়, সেই জামিয়া থেকে জামা মসজিদের সামনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ‘নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ’-দের।
মেরুকরণ, শুধুই মেরুকরণ। ফল মিলছে। দিল্লিতে বিজেপির পক্ষে হাওয়া কিছুটা ঘুরছে। মুখে উন্নয়নের কথা বললেও মোদী-শাহ জুটি লোকসভা ভোটে শুধু উন্নয়নের নৌকায় চেপে গোটা দেশে পদ্মফুল কুড়োননি। সেখানেও জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্বের মিশেল ছিল। ২০১৪-য় ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। ২০১৯-এ তা বেড়ে ৩৭ শতাংশ হয়েছে। সেই হিসেবেও ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে ২৩ কোটি মানুষের ভোট বিজেপি পেয়েছে। তাঁদের কেউ নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের কাজ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের আশ্বাস, পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আস্থা রেখেছেন। কেউ আবার প্রধানমন্ত্রীর গদিতে মোদীর কোনও বিকল্প খুঁজে পাননি। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, এই ২৩ কোটি মানুষ কিন্তু বিজেপি-আরএসএসের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পদ্মফুলে বোতাম টেপেননি।
দিল্লির ভোটের ফলাফল বলে দেবে, ‘স্কুল-মহল্লা ক্লিনিক’ বনাম ‘শাহিন বাগের ষড়যন্ত্র’ লড়াইতে জয় কার? কিন্তু দিল্লিতে যাঁরা বিজেপিকে ভোট দেবেন, তাঁদের সকলেই কি উগ্র হিন্দুত্বে বিশ্বাস করে ভোট দেবেন? সকলেই কি শাহিন বাগের মুসলিমদের বিক্ষোভে বিরক্ত হয়ে বিজেপিকে ভোট দেবেন?
না কি কেউ কেউ কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে দিল্লিতে আরও ভাল ভাবে উন্নয়নের কাজ হবে আশা করে বিজেপিকে ভোটে দেবেন?জিতুন বা হারুন, বিজেপি নেতারা প্রথমটাই বিশ্বাস করে ফেললে বিপদ। স্কুলের গণ্ডির মধ্যে আরও বেশি বিদ্বেষ ঢুকে পড়বে। একটা প্রজন্ম বড় হবে এই বিশ্বাস নিয়েই যে মুসলিম মানেই পাকিস্তানি, আর পাকিস্তানি মানেই ভারতের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী।