এ দিকে কাটমানি নিয়ে কুরুক্ষেত্র চলছে, আর ও দিকে নাকি লোকে টাকা বোঝাই মানিব্যাগ ফেরত দিয়ে যাচ্ছে!’ ঝালমুড়ির ঠোঙাটা দলা পাকিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তপেশ। ঝালমুড়ির ঠোঙাতেই খবরটা আবিষ্কার করেছে। না পড়ে ঠোঙা না ফেলার অভ্যাস তপেশের অনেক দিনের।
‘খবরটা কী?’ প্রশ্ন করল সূর্য।
‘শুধু ঠোঙা না পড়ে টাটকা কাগজ পড়লে মাসখানেক আগে জানত।’ গম্ভীর গলায় বললেন শিবুদা। ঠোঁটের কোণে অবশ্য মুচকি হাসি। ‘টেলিগ্রাফে বেরিয়েছিল খবরটা। ইউনিভার্সিটি অব জ়ুরিখের রিসার্চাররা দুনিয়ার চল্লিশটা দেশে ৩৫৫টা শহরে টাকাসুদ্ধু মানিব্যাগ রাস্তায় ফেলে দেখেছিল, কত বার সেই মানিব্যাগ ফেরত পাওয়া যায়। অবশ্যই মালিকের নাম-ঠিকানা ছিল সেই মানিব্যাগগুলোয়। দেখা গেল, মানিব্যাগে টাকা না থাকলে, বা কম টাকা থাকলে যত বার তা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে, বেশি টাকা থাকলে ফেরত পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে ঢের বেশি বার।’
‘ও সব বিলেত আমেরিকায় হয়, বুঝলেন।’ শিবুদা থামতেই ফুট কাটে শিশির। ‘এ দেশে ফেলে দেখুন, এক বারও ফেরত পাবেন না।’
‘বটে? ওই চল্লিশটা দেশের মধ্যে ভারতও ছিল, কলকাতাতেও হয়েছে এই এক্সপেরিমেন্ট।’ তপেশ উত্তর দেয়। ঠোঙা পড়ার যে কিছু সুফল আছে, মানতে বাধ্য হন শিবুদাও। বললেন, ‘ঝালমুড়ি যে ঘিলুর পক্ষে উপকারী, কোনও দিন সেটা নিয়েও নির্ঘাত রিসার্চ হবে। শিশিরের কথাটাতেও অবিশ্যি একফালি সত্য আছে। গোটা দুনিয়ায় যখন গড়ে ৫০ শতাংশ বেশি টাকাওয়ালা মানিব্যাগ ফেরত এসেছে, আর কম টাকার মানিব্যাগ ফিরেছে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে, ভারতে এই দুটো অনুপাত হল ৪৪ শতাংশ আর ২২ শতাংশ। মানে, অন্তত এই চল্লিশটা দেশের মধ্যে ভারতের লোকজন অসতের দিকে। তবে চিনের অবস্থা আরও খারাপ।’
চা দিয়ে গোপাল শিবুদার পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল। শিবুদা থামতে বলল, ‘আমাদের দেশের লোক অসৎ, এ কথা বিশ্বাস হয় না। কাগজে দেখেন না, কত ট্যাক্সিওয়ালা গয়নার ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, লাখ টাকা পেয়েও লোভ করছে না?’
‘গোপালও কি তপেশের ঝালমুড়ি খাচ্ছিস নাকি?’ চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করেন শিবুদা। ‘কথাটা ভুল বলিসনি, তবে পুরোটা ঠিকও বলিসনি। ট্যাক্সিওয়ালারা টাকা, গয়না ফিরিয়ে দিয়ে গেলে সেটা খবর হয়, আমরা জানতে পারি। কিন্তু কত জন ফেরত দেয় না, বেমালুম চেপে যায়, সেটা বোঝার জন্য পুলিশের রেকর্ড ঘাঁটতে হবে। কিন্তু সেটা কথা নয়। প্রশ্ন হল, কম টাকার চেয়ে বেশি টাকা লোকে ফেরত দিচ্ছে কেন?’ শিবুদা থামেন।
‘ড্রামাটিক পজ় দেওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছে আপনার, তাই না?’ খোঁচা দেয় তপেশ।
দুটো পারফেক্ট রিং ছেড়ে শিবুদা বললেন, ‘বাজে কথা রাখ। বছর পনেরো আগে, আমেরিকায়, আলাপ হয়েছিল ড্যান অ্যারিইলির সঙ্গে। চমৎকার ছোকরা— অল্প বয়সে বারুদের আগুনে শরীরের ৭০ শতাংশ ঝলসে গিয়েছিল। একটা ভারতীয় মেয়েকে বিয়ে করেছে। এখন বিহেভিয়রাল ইকনমিকস-এর মস্ত পণ্ডিত। সে বার কথায় কথায় বলেছিল, আসলে ভিতরে ভিতরে সবাই অসৎ— কিন্তু, বেশির ভাগ লোকের অসততার একটা লিমিট আছে।’ বুড়ো আঙুল আর মধ্যমায় তুড়ি বাজিয়ে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ছাইটাকে মেঝেয় ফেললেন শিবুদা, তার পর বললেন, ‘চুরির পরিমাণ সেই লিমিটের মধ্যে থাকলে চুরি করতে অসুবিধা হয় না। এটাকে তুই ডিজ়অনেস্টি থ্রেশোল্ড— অসততার চৌকাঠ— বলতে পারিস। চৌকাঠ পেরোলে আর বেশির ভাগ লোকই চুরি করে না।’
‘মানে, বলতে চাইছেন, কম টাকা থাকা ওয়ালেট সেই চৌকাঠের মধ্যে ছিল, আর বেশি টাকা চৌকাঠের বাইরে?’ প্রশ্ন করে শিশির।
‘একদম। ট্যাক্সিতে ফেলে যাওয়া টাকার ক্ষেত্রেও তা-ই। যত বেশি টাকা, ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।’ সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে ফেলে বললেন শিবুদা। ‘অ্যারিইলির একটা চমৎকার বই আছে— দি অনেস্ট ট্রুথ অ্যাবাউট ডিজ়অনেস্টি— তাতে লিখেছে, টাকার ক্ষেত্রে অসৎ হতে মানুষ অনেক বেশি দ্বিধা করে। এমআইটি-র হস্টেলে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। ছ’টা কোকাকোলার ক্যান আর একটা প্লেটে ছ’ডলার রেখে দিয়েছিল হস্টেলের ফ্রিজে। যে কেউ নিতে পারে সেগুলো। একটা ক্যানের দাম এক ডলার, কাজেই দুটোর মধ্যে কার্যত কোনও ফারাক নেই। দেখা গেল, এক দিনের মধ্যে কোকের ক্যানগুলো শেষ, কিন্তু ডলার পড়েই থাকল। এক বার নয়, যত বার এক্সপেরিমেন্ট হল, তত বার। ভেবে দেখ, অফিসের ক্যাশবাক্স থেকে কত জন টাকা চুরি করে? আর, কত জন নির্দ্বিধায় অফিসের প্রিন্টার থেকে ছেলেমেয়ের স্কুলের প্রজেক্টের প্রিন্টআউট নেয়, পেন নিয়ে আসে বাড়িতে? যারা আনে, তারা কি নিজেদের চোর মনে করে? কিন্তু, প্রিন্টআউট নিতে যে ক’টা টাকা লাগে, অফিস থেকে সেটুকু টাকা চুরি করলেই নিজেকে চোর মনে হত। এই যে টাকা চুরি না করা, কিন্তু অন্য ছোটখাটো জিনিস নির্দ্বিধায় ঝেড়ে দেওয়া— অ্যারিইলি বলছে, এটার পিছনে আছে ‘ফাজ ফ্যাক্টর’। নগদ টাকার সঙ্গে— বা, যে কাজটা অন্যায় হিসেবে স্বীকৃত— তার সঙ্গে একটা কাল্পনিক দূরত্ব।’
‘আপনি কিন্তু পুরো মোহনের হাতে পিস্তল! কোথা হইতে কী হইয়া গেল, আপনি বিহেভিয়রাল ইকনমিকস-এ ঢুকে পড়লেন।’ শিবুদাকে বাধা দেয় তপেশ। ‘কাটমানির কী হল, সেটা বললেন না তো।’
‘রাই ধৈর্যং, রহু ধৈর্যং।’ শিবুদা তপেশকে থামালেন। ‘কাটমানির কথা না বলে যাব না, মমতা ব্যানার্জির দিব্যি। কিন্তু, তার আগে বল, উত্তরাখণ্ডের খবরটা পড়লি? অবিশ্যি, সেটা এখনও ঠোঙা হয়নি, তোর পড়ার কথা নয়! গত তিন মাসে উত্তরাখণ্ডের ছ’টা ব্লকে একটাও মেয়ে জন্মায়নি। ২১৭টা বাচ্চা, সব ক’টা ছেলে। কন্যাভ্রূণ হত্যা ছাড়া তো এই কাণ্ডটা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক নিয়মে ছেলে আর মেয়ের সংখ্যা কাছাকাছি হবেই। বল দিকি, যদি অ্যাবরশনের সুযোগ না থাকত, তা হলে কি এই পরিবারগুলো মেয়ে সন্তান জন্মালে তাকে গলা টিপে মারত? দু’একটা ক্ষেত্রে যে মারত না, সেই ভরসা নেই— কিন্তু, বেশির ভাগ লোকই সম্ভবত মারত না। নিজের হাতে খুন না করতে পারা, অথচ মেয়ে সন্তান জন্মাবে জানতে পারলে নির্দ্বিধায় অ্যাবরশন করিয়ে ফেলা, যাতে সে না জন্মায়— এই দুটোকে জোড়ে কী, জানিস? ফাজ ফ্যাক্টর। গর্ভের মধ্যে থাকা সন্তান, যাকে দেখা যাচ্ছে না, আর নিজের হাতে মারতেও হচ্ছে না, অপারেশন করে ডাক্তারই কাজটা সেরে দিচ্ছে— সব মিলিয়ে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। অন্যায়ের সঙ্গে এই দূরত্বটাই আমাদের দিয়ে অন্যায় করিয়ে নেয়, আর তার পরও নিজেদের ভদ্রলোক ভাবতে আমাদের সমস্যা হয় না।’
শিবুদা থামলেন। অন্যরাও চুপ। এ রকম একটা খবরে মুখের ভিতরটা তেতো হয়ে যায়। কথা বলতে ইচ্ছে করে না আর।
আরও একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। গোটাকয়েক টান দিয়ে বললেন, ‘রাস্তায় ফেলে যাওয়া মানিব্যাগগুলোর কথা ভাব। বেশি টাকার ব্যাগ থেকে কিছুটা কমে গিয়েছিল কি না, রিপোর্টে লেখেনি। কমলে, কতটা কমত বল দিকি? অ্যারিইলি বলবে, পঁচিশ পারসেন্ট। পুরো টাকাটা মেরে দিলে নিজের চোখে নিজেকে চোর হিসেবে না দেখে উপায় থাকে না। কিন্তু, ডিজ়অনেস্টি থ্রেশোল্ডের মধ্যে নিলে, অথবা টাকার বদলে অন্য জিনিস নিলে এই খচখচানি থেকে মুক্তি।’
‘সে না-হয় হল, কিন্তু কাটমানির কী হল?’ তপেশ নাছোড়বান্দা।
‘আপনার— থুড়ি, অ্যারিইলির যুক্তিগুলো খাটবে কি?’ সূর্যের গলায় সংশয়। ‘কাটমানিতে অনেক টাকা, আর পুরোটাই নগদ টাকার কারবার। কাজেই, থ্রেশোল্ড আর ফাজ ফ্যাক্টর, দুটোতেই তো এই চুরি আটকে যাওয়ার কথা ছিল।’
‘সে তো বটেই।’ সূর্যের কথায় সায় দেন শিবুদা। ‘এই ক্ষেত্রে কী হয়, সে কথায় যাচ্ছিলাম। কিন্তু, তপেশ যে রকম অধৈর্য হয়ে উঠছে, তাতে আর বেশি ক্ষণ ওকে ঠেকিয়ে রাখলে ও বিজেপি জয়েন করে ফেলবে। কাজেই, উত্তরটা দিয়েই দিই। ফাজ ফ্যাক্টর বস্তুটা এক রকম নয়, মানে, স্বীকৃত অপরাধের সঙ্গে কাল্পনিক দূরত্ব বাড়ানোটাই শুধু ফাজ ফ্যাক্টর নয়। অপরাধটাকে ‘স্বীকৃত’ হিসেবে গণ্য না করাও এক ধরনের ফাজ। ভেবে দেখ, নেতারা পয়সা খায়, এটা কি পশ্চিমবঙ্গে আজ আর কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা? একেবারেই নয়। একা তৃণমূলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এই পাপ বামফ্রন্টের আমল থেকে চলছে। চলতে চলতে এমন হয়েছে যে নেতার কাটমানি খাওয়াটাকে সবাই নিতান্ত স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে। স্বাভাবিক, ফলে সেই কাজটার মধ্যে যে অপরাধ আছে, এই কথাটা নেতারা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। অনৈক্যতার সঙ্গে কাল্পনিক দূরত্ব— ফাজ ছাড়া কী বলবি একে? অল্পবিস্তর কাটমানি খেলে— মানে, ওই চৌকাঠটুকু না পেরোলে— মানুষও এই নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাত না। গোগ্রাসে খেতে গিয়েই গোলমাল হয়ে গেল।’
‘ফেরত দেবে বলে আরও গোলমাল পাকিয়েছে।’ মন্তব্য তপেশের। ‘প্রশান্ত কিশোরের তরী এ বার ডুববে।’
‘অত সহজ নয়, বৎস!’ আরও একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। বললেন, ‘কিছু টাকাও যদি সত্যি ফেরত দেওয়া যায়, খেলা সম্পূর্ণ ঘুরে যেতে পারে। কিন্তু, সে কথা আজ নয়। ঝালমুড়ি খাওয়া পেটে এক দিনে এতটা হজম করতে পারবি না।’