2020 United Nations Climate Change Conference

একমাত্র পথ হল আলোচনা

সম্মেলনের সময় মধ্য মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় রাস্তা পেসিও ডি লা ক্যাস্তলেনায় মানুষের যে ঢল নেমেছিল, মাদ্রিদ তেমন মিছিল আগে কখন দেখেনি।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০০
Share:

এ বারের মাদ্রিদ জলবায়ু সম্মেলন ‘হতাশাজনক’, বললেন স্বয়ং সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল। না, পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য দেশগুলির কাছে যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, তা গুরুত্ব পেল না রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে, বিশেষত উন্নত দেশগুলির কাছে। কেউ কেউ তো বলছেন, সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চলা আন্তর্দেশীয় আলোচনার বন্দোবস্তটাই শেষ হওয়া উচিত। তবে, প্রায় এক দশকব্যাপী এই ‘আলোচনা’ বা দরাদরি দেখার পর বলাই যায় যে, আলোচনার ধরন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বিশ্বের জলবায়ু সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এ ছাড়া কোনও পথ নেই।

Advertisement

সম্মেলনের সময় মধ্য মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় রাস্তা পেসিও ডি লা ক্যাস্তলেনায় মানুষের যে ঢল নেমেছিল, মাদ্রিদ তেমন মিছিল আগে কখন দেখেনি। এই রাস্তার ওপরেই রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম, অর্থাৎ এখানে রিয়ালের বিজয় মিছিল কম হয়নি। কিন্তু সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে কয়েক লক্ষ মানুষ গোটা পৃথিবী থেকে এসে জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে বিশ্বের রাজনীতিকদের ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গলা মেলাচ্ছেন, পায়ে পা মেলাচ্ছেন; এ এক আশ্চর্য ঘটনা। লক্ষ লক্ষ মানুষের গলায় একটাই আবেদন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরম বিপন্ন পৃথিবী। মাদ্রিদে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আসা রাজনীতিকরা যেন নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের দরকষাকষি থেকে বেরিয়ে এসে একবার পৃথিবীর জন্য ভাবেন। এই আকুতি তখন সর্বত্র, মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালেও বড় বড় করে লেখা স্লোগান: ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বলার দিন চলে গেছে; বলুন জলবায়ুর ‘জরুরি অবস্থা’ জারি হয়েছে!

সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই বিজ্ঞানীরা জানালেন যে, প্যারিসে বিভিন্ন দেশ পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস যে মাত্রায় কমানোর অঙ্গীকার করেছিল, তার পরিমাণ অন্তত তিন গুণ না বাড়ালে শিল্পায়ন-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি দূরস্থান, ২ ডিগ্রির মধ্যে রাখাই সম্ভব হবে না। এবং এই কমানোর কাজটা শুরু করতে হবে এখনই, ২০২০ সালে। রিপোর্টগুলি জানাল যে যেমন চলছে, তেমন চলতে থাকলে এই শতাব্দীর শেষেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রির ওপর বাড়তে পারে। আইপিপিসি একটি রিপোর্টে জানিয়েছে, মাত্র ১.৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লেই পৃথিবীর একটা বড় অংশ তীব্র বিপন্নতার সম্মুখীন হবে, হ্রাস পাবে জৈববৈচিত্র। ফলে তার দ্বিগুণ তাপমান বাড়লে যে কী প্রলয়ের সামনে আমরা পড়ব, তা সহজেই অনুমেয়। সমুদ্রের তল ও জল ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে বিপর্যয়ের সংখ্যা ও তীব্রতা। আর সে তালিকায় ভারত একেবারে সামনের সারিতে।

Advertisement

কিন্তু হায়, এমন প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও মাদ্রিদ জলবায়ু সন্মেলনে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল না। না হল বিশ্বের সামগ্রিক কার্বন নিঃসরণ কমানোর বন্দোবস্ত, না মিলল আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অর্থের সন্ধান। জানা গেল না ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় বিপর্যস্ত অঞ্চলের (সুন্দরবনের মতো) ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব কে নেবে। উন্নয়নশীল দেশগুলি ইতিমধ্যেই ঘটে-যাওয়া জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য (যার পোশাকি নাম লস এন্ড ড্যামেজ) আলাদা করে অর্থের দাবি করল, তাতে বাগড়া দিল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া-সহ বেশ কয়েকটি দেশ। আগামী বছর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর জন্য উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে অন্যান্য দেশগুলির যে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার কথা। তারও আশ্বাস মিলল না।

তবে কী লাভ এমন সম্মেলনে? সত্যি কি তবে আন্তর্দেশীয় আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত? প্রসঙ্গত, কোনও জলবায়ু সম্মেলনেই ভোটাভুটির ব্যবস্থা নেই, সম্পূর্ণ ঐকমত্য না হলে কোনও সিদ্ধান্ত হয় না। ফলত প্রক্রিয়াটি অনেক সময়ে গতিহীনতায় ভোগে। উন্নত দেশগুলি এক দশক আগে অবধি শিল্পায়নের নামে একচ্ছত্র কার্বন নিঃসরণে অভ্যস্ত ছিল, সুতরাং তাদের উল্টো পথে হাঁটতে বাধ্য করতে সময় লাগবে। সময় লাগবে পৃথিবীর জলবায়ু সমস্যায় তাদের ভূমিকার কথা পুরোপুরি স্বীকার করিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ বার করতে। সময় লাগলেও এটাই একমাত্র পথ। কারণ পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে ও দেশগুলি আইনানুগ ভাবে তাতে যুক্ত থাকছে। খেয়াল রাখতে হবে যে এত কিছু ‘ব্যর্থতার’ মধ্যেও মাদ্রিদে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি সমেত বহু দেশ ২০৫০ সালে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ‘শূন্য’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লস এন্ড ড্যামেজ প্রক্রিয়ায় টাকার জোগান না হলেও, উন্নত দেশগুলি আগের তুলনায় এই পদ্ধতিকে গতিশীল করার সিদ্ধান্তে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে।

তাই ‘দড়ি ধরে মার টান, রাজা হবে খানখান’ স্টাইলে ঝাঁপিয়ে পড়া না গেলেও ক্রমেই চাপ বাড়াতে হবে। মানুষ কিছু প্রবল ভাবে চাইলে শেষে সব রাজনীতিককেই মেনে নিতে বা সরে যেতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement