ঐতিহাসিক: ভারতীয় সংবিধানে স্বাক্ষর করছেন জওহরলাল নেহরু। ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০
সম্প্রতি বেশ কিছু রাজনৈতিক বিতর্ক সাংবিধানিক প্রশ্ন ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। যেমন কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৭০ ধারা একটি স্থায়ী না অস্থায়ী ধারা ছিল, কিংবা আজ দেশ যা নিয়ে উত্তাল সেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন সংবিধানের ১৪তম ও ১৫তম ধারাকে লঙ্ঘন করে কি না। এই সব তর্কে দেশের ইতিহাসের অনেক প্রশ্নও নতুন করে উঠে আসে— যেমন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ও অন্যত্র ৩৭১ ধারার মধ্যে তফাত কী? কী ধরনের সাংবিধানিক শর্তের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়; অথবা, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের সমর্থনে বলা হয়, যে ঔপনিবেশিক ভারত ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল, তা কি তর্কাতীত ভাবে সত্যি? এই সব প্রশ্ন শুধু বিশেষজ্ঞ মহলের প্রশ্ন নয়। বন্ধুদের সঙ্গে ফোনালাপে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে চলছে এই সব চর্চা। কখনও কেউ পাঠাচ্ছেন নতুন আইনের পাঠ, কেউ পাঠাচ্ছেন বরিষ্ঠ আইনজীবীদের ভাষ্য, কখনও নিজেদের আইনজ্ঞ বন্ধুদের মতামত জিজ্ঞেস করছি। সব মিলিয়ে সংবিধান নিয়ে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে এই রকম উদ্দীপ্ত, কখনও বা রীতিমতো গরম, আলোচনা আগে দেখিনি।
ফলে কোনও কোনও বিশিষ্ট মানুষ প্রশ্ন করছেন, এটাই কি ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় সাংবিধানিক মুহূর্ত? এক সময় আমাদের নেতারা অনেক আলোচনা করে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁদের সেই তর্কবিতর্ক সংবাদপত্রে আলোচিত হত। বিজেপির সঙ্গে একমত হই বা না-হই, আজ কি তবে সেই রকম আলোচনার দিন আবার ফিরে এল?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে আজকের এই আইন প্রণয়ন ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও তৎসংলগ্ন আলোচনার, ডাক্তারি শাস্ত্রের ভাষায় একটি কাম্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। মনে হতে পারে যে, আজকের তর্কমুখর আলোচনার মাধ্যমে ভারতে এক দল নাগরিক তৈরি হচ্ছেন, যাঁরা সংবিধান ও তার নানান ধারার সম্বন্ধে আগের চেয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল হবেন ও এর ফলে হয়তো ভারতীয় গণতন্ত্রই শক্তিশালী হবে। গত কয়েক দশক ধরে দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের হয়ে সংবিধানের আইনগত সফল ব্যবহার দেখে কিছু কিছু অ্যাকাডেমিক সজ্জন ভাবতেও শুরু করেছিলেন যে সত্যিই হয়তো ভারতীয় সংবিধান ধীরে ধীরে গরিব মানুষের জন্য দৈনন্দিন সংগ্রামে ব্যবহার্য একটি ক্ষমতাশালী অস্ত্র হয়ে উঠছে।
এ নিয়ে তো সন্দেহ নেই যে নানা রকম আন্দোলন, বাদপ্রতিবাদের ভিতর দিয়ে গিয়ে সংবিধান সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞান আমাদের গত দু’দশকে কিছুটা হলেও বাড়ছে। সুতরাং প্রশ্ন করাই যেতে পারে— আগের চেয়ে বেশি মানুষ সংবিধান বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে দেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের ভিতটিই কি আরও মজবুত হচ্ছে না?
দুঃখের বিষয়, এ প্রশ্নের উত্তর নঞর্থক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাফল্যের মূলে যা কাজ করে, তা হল, একটি অধরা কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় বস্তু— আস্থা। এই আস্থা যে, সংবিধানটা নিছকই একটি রাজনৈতিক কলাকৌশলের অস্ত্র নয়। সকল তর্কবিতর্কের ঊর্ধ্বে আমাদের সংবিধানে যে সকল মূল্যবোধ বিধৃত আছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সেই মূল্যবোধগুলিই তুলে ধরতে চান। যা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি মনে হয়, তা হল রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ওপর জনসাধারণের সর্বজনীন আস্থা।
ভারতের প্রথম সাংবিধানিক মুহূর্তটি ছিল নানান সঙ্কটের সময়। যখন দেশের নেতারা সংবিধান প্রণয়ন করছেন, তখনও দেশভাগের ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শরণার্থী আগমন, খাদ্য সঙ্কট ইত্যাদি চলছে। তা সত্ত্বেও ভারতের সকল জনসাধারণ দেশের নেতাদের ওপর— তাঁদের মধ্যে সমস্ত মতামতের পার্থক্য নিয়েই— আস্থা রেখেছিলেন। আমরা বড় হতাম এটা ধরে নিয়ে যে, সাংবিধানিক কূটকচালে চিন্তা আইনজীবী আর রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। সত্যি কথা, যে আজকের অল্পবয়সিদের তুলনায় আমরা অনেক বেশি সাংবিধানিক অজ্ঞতার মধ্যে বড় হয়েছি। এমনকি ১৯৭৫-এ চালু হওয়া জরুরি অবস্থা যে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করেছে, এ বিষয়ে কারও সন্দেহ না থাকলেও আমেরিকায় যেমন লোকে কথায় কথায় তাঁদের সংবিধানের প্রথম ও দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবের কথা তুলে বাক্স্বাধীনতার বা ব্যক্তিগত ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার অধিকারকে তুলে ধরেন, আমরা কখনও আমাদের তর্কাতর্কিতে আমাদের সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারার দোহাই পাড়তাম না।
ইস্কুলে থাকতেই মোটামুটি জানতাম যে আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক, বাক্স্বাধীনতা, যার যার নিজস্ব ধর্মের সূত্র অনুযায়ী জীবনযাপনের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ইত্যাদি আমাদের আছে। জানতাম যে আমরা পাকিস্তানের মতো নই। ধর্মের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা তৈরি করে সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু আমাদের দেশ, ভারত, তা নয়। ভারতে ধর্মের সঙ্গে সরকারের বা নাগরিকত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। সেই অর্থে, ইন্দিরা গাঁঁধী কথাটি সংবিধানে ঢুকিয়ে দেওয়ার আগেই আমরা জানতাম, কিছু না-ভেবেই জানতাম— আমরা সেকুলার।
আজকের বিক্ষুব্ধ ভারতকে দেখলে মনে হয় যে সংবিধানের অনেক মূল কথাই প্রশ্নের মুখে। সেকুলার বলতে কী বোঝায় তাই নিয়েই আজ সংসদে কত বচসা! সংবিধানকে কেবল আক্ষরিক অর্থে সম্মান দেখালে ও তার আত্মিক (স্পিরিচুয়াল) দিকটির কথা না ভাবলে সংবিধান কি একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় না? একটা কাল্পনিক উদাহরণ দিয়ে বলি। নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মামলা হবে, এটা আমরা জানি। ধরুন, আমাদের মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট সায় দিল, নতুন নাগরিকত্ব সংশোধন আইনটি অসাংবিধানিক নয়। আইনটি ঠিকই আছে। সুপ্রিম কোর্টের মতামত অবশ্যই মান্য। কিন্তু আইনটি নিয়ে অনেক মানুষের যে উৎকণ্ঠা— যদি ধরেও নিই যে সবটাই বিরোধীদের অপপ্রচারের ফসল— তা কি কমবে? কমার তো কোনও কারণ নেই। কারণ আজ যাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন আইনটিকে বরবাদ করার জন্য, আইনটি সাংবিধানিক প্রমাণ হলেই যে তাঁদের আশঙ্কা দূরীভূত হবে, এমন তো নয়। সাংবিধানিক হলেও আইনটি তাঁদের বেকায়দায় ফেলবে বলে তাঁরা ভয় পাবেন।
এই ভয় ও সন্দেহের বাতাবরণটিই গণতন্ত্র বা সাংবিধানিক শাসনের পক্ষে ক্ষতিকর। অথচ ভারতীয় রাজনীতিতে আজ নেতাদের প্রতি নেতাদের, নেতাদের প্রতি মানুষের, পারস্পরিক সন্দেহ ও অনাস্থার ভাষা না-শুনে উপায় নেই। নানান ঘটনায় মনে হয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাতেও আস্থা পড়তির দিকে। তেলঙ্গানায় সাম্প্রতিক তথাকথিত ‘এনকাউন্টার’-এ যাঁরা উল্লসিত হলেন, তাঁরা স্পষ্টই জানালেন যে বিচারব্যবস্থায় তাঁদের আস্থা নেই। আজ যাঁরা নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিক্ষুব্ধ, তাঁদের শাসক দলের সদিচ্ছায় আস্থা নেই। অপর দিকে শাসক দল বলছে, সমস্ত বিক্ষোভের মূলে বিরোধীদের প্ররোচনা, তাঁরাই ভারতের ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’।
গণতন্ত্রই বলুন বা সংবিধানই বলুন, সবই প্রাণ পায় দেশের রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা ও সরকার-পুলিশে মানুষের আস্থায়। আজ অনেক সাংবিধানিক প্রশ্ন জরুরি হয়ে পড়লেও এই আস্থার যে অভাব ঘটেছে তার চিহ্নও জাতীয় জীবনে পরিষ্কার। এমনকি ‘ফেক নিউজ়’-এর প্রাদুর্ভাবের কারণে হাতে যে সব তথ্য ‘না চাহিলেও’ পাওয়া যায়, তার যাথার্থ্য সম্বন্ধে আমরা ন্যায্যতই সন্দিহান থাকি। এই অবস্থায় সংবিধান নিয়ে আলোচনার তীব্রতা বাড়লেও, তাকে ভারতের দ্বিতীয় সাংবিধানিক মুহূর্ত বলা যাবে কি না, তা অনিশ্চিত। বরং নিশ্চিত করে বলা যায় এই অনাস্থার ঘুণপোকাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিতে সত্যিকারের ‘ঘুসপেটিয়া’।
ভারতীয় রাজনীতি কতকগুলো সাধারণ সাংবিধানিক মূল্যবোধ সবার মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারবে, ভারতহিতৈষী গণতান্ত্রিক মানুষেরা এই আশা নিয়েই বেঁচে থাকেন। আশাপ্রদ ঘটনা এটাই যে এই মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আজ সম্প্রদায়নির্বিশেষে এত মানুষের প্রতিরোধ ও ত্যাগস্বীকার। তবে এর রাজনৈতিক পরিণতি কী, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক: ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো