Digital Media

বাহির হইল ঘর

গৃহকোণে বসিয়া স্কুলের ক্লাস করিবার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিসরের প্রয়োজন হয়, যেখানে অন্যদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রিত, নানাবিধ শব্দের উৎপাত নাই। তাহা না হইলে শিক্ষার্থীর মনঃসংযোগ ব্যাহত হয়, বিভিন্ন ধরনের গোলযোগে শিক্ষকদেরও অসুবিধা হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share:

প্রতীকী ছবি।

কলিকাতার কয়েকটি স্কুল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি শিক্ষকশিক্ষিকাদের পরামর্শ দিয়াছেন, গৃহবন্দি ছাত্রছাত্রীদের ‘ডিজিটাল ক্লাস’-এ পড়াইবার সময় তাঁহারা যেন ওই ছেলেমেয়েদের বাড়ির পরিস্থিতি মাথায় রাখিয়া তাহাদের প্রতি ও তাহাদের পরিবারের লোকজনের প্রতি সহৃদয় থাকিবার চেষ্টা করেন, নানাবিধ গোলযোগ এবং সমস্যায় বিরক্ত না হইয়া যথাসম্ভব মানাইয়া লন। কেন এমন আবেদনের প্রয়োজন হইল, অনুমান করা কঠিন নহে। অনেক শিক্ষার্থীর বাড়িতেই সম্পূর্ণ একান্তে বসিয়া লেখাপড়া করিবার সুযোগ নাই। গৃহকোণে বসিয়া স্কুলের ক্লাস করিবার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিসরের প্রয়োজন হয়, যেখানে অন্যদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রিত, নানাবিধ শব্দের উৎপাত নাই। তাহা না হইলে শিক্ষার্থীর মনঃসংযোগ ব্যাহত হয়, বিভিন্ন ধরনের গোলযোগে শিক্ষকদেরও অসুবিধা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের, এবং তাহাদের মারফত অথবা সরাসরি অভিভাবকদের অনুরোধ জানাইয়াছেন এই বিষয়ে নজর রাখিতে। কিন্তু তাহাতে যথেষ্ট কাজ হয় নাই। অনেকের উপায় নাই, আবার অনেকে উপায় থাকিলেও ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সুপরিবেশ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নহেন। তাহার উপরে অনেক অভিভাবকই সন্তানের লেখাপড়া বিষয়ে, স্কুলের শিক্ষকরা কী পড়াইতেছেন, কেমন পড়াইতেছেন, তাঁহার বাছাটির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী কি না— এই সকল বিষয়ে অতিমাত্রায় কৌতূহলী। ডিজিটাল ক্লাস তাঁহাদের সেই কৌতূহল চরিতার্থ করিবার অভূতপূর্ব এবং অপ্রত্যাশিত ‘সুযোগ’ করিয়া দিয়াছে। মুশকিলে পড়িতেছে শিক্ষার্থীরা, মুশকিল শিক্ষকদেরও। অনুমান করা যায়, বিরক্তির পারদ চড়িতেছে, মনোমালিন্যও অনিবার্য। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ওই সহৃদয়তার আবেদন।

Advertisement

সমস্যাটি কেবল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে নহে, কর্মজগতেও। অতিমারির প্রকোপে যাঁহাদের বাড়িতে বসিয়া অফিসের কাজ করিতে হইতেছে, তাঁহাদের অনেকের দৈনন্দিন জীবনেই এমন বিচিত্র সব সমস্যার উদয় হইয়াছে, যাহা আগে ভাবা যায় নাই। সেই সকল গোলমাল এবং উপদ্রব লইয়া সত্য-মিথ্যা মিশাইয়া রকমারি রঙ্গকৌতুক তৈয়ার হইয়াছে এবং ডিজিটাল মাধ্যমে ভাইরাসের মতোই ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বাড়ির পোশাকে, কার্যত অর্ধ-আবৃত দেহে আদালতের ডিজিটাল বিচারসভায় সওয়াল করিতে গিয়া আইনজীবী স্তম্ভিত এবং ক্রুদ্ধ বিচারপতির তীব্র ভর্ৎসনা শুনিয়াছেন— গল্প নহে, সত্য ঘটনা! স্পষ্টতই, দৈনন্দিন জীবনাচরণে এই সব অসঙ্গতির মূলে রহিয়াছে সামগ্রিক পরিস্থিতির অসঙ্গতি। জীবনধারাটি সহসা দিগ্‌ভ্রষ্ট হইলে চেতনার স্তরেও তাহার প্রভাব পড়িতে বাধ্য। কি স্কুলের শিক্ষার্থী, কি অফিসের কর্মী, কি আদালতের আইনজীবী, সকলের আচরণই এই পরিবেশে বিস্রস্ত হইতে পারে, হইতেছেও।

এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির গভীরে রহিয়াছে একটি বড় রূপান্তরের সঙ্কেত। গৃহজীবন এবং কর্মজীবন, দুইটি পরিসরকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন বলিয়া জানিবার যে অভ্যাস নাগরিক সমাজের মজ্জাগত, তাহার বয়স খুব বেশি নহে। শিল্পবিপ্লবের পূর্ববর্তী সমাজে এমন বিভাজন বিশেষ ছিল না, কাজের জগৎ লোকের পারিবারিক পরিসরের অন্তর্ভুক্ত অথবা সংশ্লিষ্ট থাকিত। বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষ দৈনন্দিন পরিমণ্ডলের বাহিরে যাইতেন, কিন্তু অধিকাংশের জীবনেই তাহা ছিল বিরল ব্যতিক্রম। কৃষি এবং স্থানীয় হস্তশিল্প ও ছোটখাটো বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতিতে মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত ব্যতীত কাহারও ঘর এবং বাহিরের মধ্যে বিভাজনের প্রয়োজন হইত না। বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। পথের পাঁচালী-র প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের পাঠশালা, দোকান এবং বৈঠকখানা ছিল অনায়াসে একাকার। শিল্পনির্ভর অর্থনীতি আসিয়া সেই ধারা পাল্টাইয়া দেয়, ঘরের মানুষ প্রত্যহ কাজে বাহির হয়, ছাত্রছাত্রীরা প্রত্যহ পিঠে ব্যাগ লইয়া স্কুলকলেজে যায়। কোভিড সংক্রমণের আতঙ্ক এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ, এই যৌথ ক্রিয়ায় আবার পর্বান্তরের সঙ্কেত। ঘর ও বাহিরের পুরাতন ঐক্যে ফিরিবার কোনও প্রশ্ন নাই, ইতিহাস বৃত্তাকারে আবর্তিত হয় না। লক্ষণ দেখিয়া মনে করিবার কারণ আছে যে, এই নূতন দুনিয়ায় কর্মক্ষেত্র ক্রমে গৃহপরিসরটিকে গ্রাস করিয়া লইবে। অফিস-কাছারি এবং স্কুলকলেজ ঘরে ঢুকিয়া আসিবে। গৃহবন্দি ছাত্রছাত্রীদের ডিজিটাল ক্লাসে তাহারই নানা রূপরেখা অঙ্কিত হইয়া চলিয়াছে। এমন কল্পান্তর কি নির্ঝঞ্ঝাট হইতে পারে?

Advertisement

যৎকিঞ্চিত

লড়াইটা অন্ধকারের সঙ্গে। সেই লড়াইয়ে তাইল্যান্ডের রাজপথ দেখল স্বদেশের হ্যারি, রন, হারমায়নিদের। সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিরুদ্ধে জমায়েতে কণ্ঠ ছাড়ল তারুণ্য। আওয়াজ আত্মশুদ্ধকরণের। লক্ষ্য, ভল্ডেমর্ট তথা যক্ষপুরীর অচলায়তন ভাঙা, গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা। ওরা জানে, হ্যারিদের কপালে ভল্ডেমর্টরা সামান্য ক্ষতচিহ্ন আঁকতে পারে শুধু, অন্তিমে ঠাঁই পায় বিস্মৃতির অন্ধকারে। তখন মলয়বাতাসে অনন্ত কুইডিচ খেলে যায় মুক্তচিন্তা আর মানবাধিকার...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement