ইচ্ছুক নাগরিকদের জন্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ডের ব্যবস্থা করা হইবে— এই ঘোষণাটির মধ্যে নাগরিকের স্বাধিকারকে স্বীকৃতি দিবার একটি বিরল প্রচেষ্টা আছে। তাহার অধিষ্ঠান ‘ইচ্ছুক’ শব্দটিতে। এই কার্ডে রোগীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে তথ্য সঞ্চিত হইবে, তাহা কে দেখিতে পারিবেন, তাহা এখনও অজ্ঞাত। ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রটির অবস্থা হইতে অনুমান করা চলে, এই তথ্যভান্ডার বহু লোকের নিকট উন্মুক্ত না করিয়াও উপায় নাই। ফলে, এই ক্ষেত্রে রোগীর গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘিত হইবে, তেমন আশঙ্কা থাকেই। উন্নততর সামগ্রিক চিকিৎসা পরিষেবা না কি ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা— কোনও রোগী কোনটিকে বাছিবেন, সেই অধিকার তাঁহাকে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। সামগ্রিক প্রকল্পটিও ভবিষ্যতের দিকে এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। রোগীর তথ্যভান্ডার চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থাকিলে তাহার একাধিক সুবিধা। যথাযথ রোগনির্ণয় সহজতর হইবে, দ্রুততর চিকিৎসার ব্যবস্থা হওয়া সম্ভব, দেশের যে কোনও প্রান্তে চিকিৎসা সম্ভব। ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ডকে স্বাগত জানানোই বিধেয়।
তবে, তথ্যের অভাবে যত রোগীর প্রাণহানি ঘটে, পরিষেবার অভাবে যে তাহার বহু গুণ বেশি মানুষ মারা পড়েন, এই কথাটিও ভুলিলে চলিবে না। ভারতে প্রতি দুই হাজার নাগরিক পিছু হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায় অন্তত এক জন চিকিৎসক থাকিবার কথা বলে, তখন ভারতে প্রতি দেড় হাজার জনে চিকিৎসকের সংখ্যা এক। তাহার উপর আছে শহর ও গ্রামের প্রভেদ— গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কার্যত একটি নিষ্ঠুর রসিকতা থাকিয়া গিয়াছে। চিকিৎসকরা গ্রামে যাইতে অনিচ্ছুক, ফলে গ্রামীণ ভারত চিকিৎসার জন্য নির্ভর করিয়া থাকে হাতুড়েদের উপর। শহরের সুপার স্পেশালিটি সরকারি হাসপাতালে এমনই রোগীর চাপ যে, এক জন রোগীকে গড়ে এক মিনিট সময় দেওয়াও বহু ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সাধ্যাতীত হয়। আছে সরকারি-বেসরকারি ভাগও। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে বিমার মাধ্যমে গরিব মানুষেরও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা হইয়াছে— তবে তাহা নেহাতই খাতায়-কলমে। এই পরিস্থিতিতে রোগী বিষয়ে যাবতীয় তথ্য কার্ডে ভরিয়া দিলেই বা লাভ কী?
কোভিড-১৯’এর জরুরি অবস্থায় যেখানে বহু বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা পিছাইয়া গিয়াছে, তখন ত্রাতা হইয়া উঠিয়াছে সরকারি হাসপাতালগুলিই। অতিমারি একটি কথা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে— জনস্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হইলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ব্যতীত গতি নাই। তাহার জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে অধিগ্রহণ করিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ক্রমশ বেসরকারি হাতে ছাড়িয়া নিশ্চিন্ত হওয়াও চলিবে না। সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধি। দেশের জিডিপির এক-দেড় শতাংশ খরচ করিলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কী হাঁড়ির হাল হয়, ভারত তাহা অভিজ্ঞতায় শিখিয়াছে। সেই ভুলটি দীর্ঘায়িত না করাই বিধেয়। স্বাস্থ্যনীতির অভিমুখ পরিবর্তনেরও প্রয়োজন আছে। বিমার মাধ্যমে চাহিদাভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিষেবা নহে, ভারতের প্রয়োজন দ্বিবিধ নীতি— এক দিকে প্রকৃত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার মাধ্যমে রোগের সম্ভাবনা হ্রাস; অন্য দিকে, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে জোগান বৃদ্ধি। সেই দায়িত্ব সরকারের। রোগীর তথ্যভান্ডার তৈরি হউক, কিন্তু সেই তথ্য ব্যবহার করিয়া প্রকৃত চিকিৎসার ব্যবস্থাও যাহাতে হয়, তাহা নিশ্চিত করিতেই হইবে। নচেৎ গোটা প্রকল্পটিই একটি বৃহৎ প্রহসনে পর্যবসিত হইবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই জমানার অধিকাংশ সংস্কারই শেষ অবধি প্রহসন বই আর কিছু হইয়া উঠে না। স্বাস্থ্যক্ষেত্র একটি ব্যতিক্রম হউক।