বিতর্কিত: সালভাটর এডওয়ার্ড লুরিয়া ও জেমস ডিউই ওয়াটসন। গেটি ইমেজেস
আত্মজীবনী জনপ্রিয় হয়, হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়, যদি তা হয় ‘আনঅথরাইজ়ড’। মানে, এমন জীবনী, যা লেখায় কোনও হাত থাকে না যাঁর জীবন তাঁর। হাত থাকলে তিনি তো বাদ দেবেনই তাঁর চরিত্রের খারাপ দিকগুলো। ক’জন আর এমন সাহসী হতে পারেন যে, তাঁর মন্দ যা কিছু, তা-ও উজাড় করে বলার পক্ষপাতী? আর অটোবায়োগ্রাফি? যদি তা হয় ‘কিস অ্যান্ড টেল’। অর্থাৎ, আপন কীর্তি-কেলেঙ্কারি ফাঁস। বড় বড় মানুষেরা শুধু যে মহত্ত্বের বর্মে ঢাকা পড়ে থাকেন না, তাঁরাও যে আর পাঁচ জনের মতো রক্তমাংস দিয়ে গড়া; বিশেষত ষড় রিপুর শিকার, তা জানলে পাঠকের ভাল লাগে। বইয়ের বিক্রি বাড়ে।
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় জেমস ডিউই ওয়াটসন-এর লেখা দ্য ডাবল হেলিক্স। এই পৃথিবীতে প্রাণের মূল যে ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) অণু, তা আগে জানা থাকলেও, সেই অণুটি কেমন দেখতে, তা জানা ছিল না। জানার চেষ্টা এক প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সে দৌড়ে যোগ দিয়েছিলেন অনেক তাবড় বিজ্ঞানী। তাঁদের পিছনে ফেলে ওয়াটসন এবং তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস হ্যারি কম্পটন ক্রিক ১৯৫৩ সালে ডিএনএ-র আকৃতি চিনে ফেলেন। সাফল্যের জন্য ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কারও পান ওঁরা। সঙ্গে আর এক গবেষক, মরিস হিউ ফ্রেডরিক উইলকিন্স। দ্য ডাবল হেলিক্স হল সেই আবিষ্কার-কাহিনি। কিন্তু তাতে মিশে থাকে ওয়াটসনের এবং ক্রিকের জীবনের নানা ঘটনা। সে অর্থে দ্য ডাবল হেলিক্স আত্মজৈবনিক রচনা। ওয়াটসনের অকপট লেখনী পড়ে সমস্ত পাঠক তো বটেই, ক্রিক অবধি ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্ক্যান্ডালাইজ়ড’। কেন? ওয়াটসন কেবল নিজের নারীসঙ্গলাভের বর্ণনা দেননি, সে ব্যাপারে লিখেছেন বন্ধু ক্রিকের কিস্সাও। সে দিকে ক্রিক যে কত আনাড়ি, এবং সে বাবদে তাঁর যে হেনস্থাও হয় মাঝে মাঝে, সে বর্ণনাও দিতে ভোলেননি।
দ্য ডাবল হেলিক্স যেন ট্রেন্ডসেটার হয়ে দাঁড়াল। অনেকেই ও-বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হন ওই স্টাইলে আত্মজীবনী লেখায়। দু’জনের কথা এখানে বলব। দু’জনেই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। প্রথম জন ওয়াটসনের পিএইচ ডি গাইড সালভাটর এডওয়ার্ড লুরিয়া। ১৯৮৪ সালে তাঁর আত্মজীবনী বেরোয়— আ স্লট মেশিন, আ ব্রোকেন টেস্ট টিউব। বইয়ের ভূমিকাতেই লুরিয়া লেখেন, তিনি ছাত্রের লেখা বই পড়ে মুগ্ধ। আত্মজীবনীতে থাকবে স্বীকারোক্তি। আ স্লট মেশিন-এ লুরিয়া সবিস্তার জানান তাঁর মানসিক অবসাদ রোগের কথা। অন্য জন রিচার্ড ফিলিপ্স ফাইনম্যান। যাঁকে দ্য ডাবল হেলিক্স-এর পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়েছিলেন ওয়াটসন। আর, তা পড়ে গবেষণার চড়াই-উতরাই কিংবা প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ওয়াটসনের বর্ণনা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন তিনি। সেই ফাইনম্যান ১৯৮৫ সালে লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী। শিয়োরলি ইউ আর জোকিং, মিস্টার ফাইনম্যান! বইতে নিজের মজারু চরিত্রের নানা বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা। এমনই এক অভিজ্ঞতা হল আগন্তুক এক মহিলাকে শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া, ও মহিলার তাতে রাজি হয়ে যাওয়া!
পাঠক, যদি ভাবেন আত্মজীবনীতে এ রকম অকপট স্বীকারোক্তি আধুনিকতার উপহার, তা হলে ভুল করবেন। আত্মজৈবনিক লেখায় ষোড়শ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার যে সব কথা শুনিয়েছেন, তা এই একবিংশ শতাব্দীতেও তাক লাগায়। জ্যোতিষচর্চা করতেন এই বিজ্ঞানী। শেষ জীবনে এর-তার কোষ্ঠী বানিয়ে দু’পয়সা রোজগারও করতেন। নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন, মায়ের গর্ভে আমার ভ্রূণসঞ্চার হয়েছিল ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে ভোর রাত ৪টে বেজে ৩৭ মিনিটে। হিসেব বলছে, আমার মা তাঁর বিয়ের সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। জন্মকালে আমি যে দুর্বল ছিলাম, সারা জীবন আমি যে নানা রোগে ভুগেছি, তার কারণ, আমি জন্মেছিলাম ঠিক সময়ের আগে। গর্ভসঞ্চারের ৩২ সপ্তাহ— ২২৪ দিন, ১০ ঘণ্টার মাথায়।
এর একেবারে উল্টো মেরুতে থাকবে আলবার্ট আইনস্টাইনের আত্মজীবনী। অথচ, তাঁর জীবনও তো কম ঘটনাবহুল নয়। স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ের সঙ্গে তরুণ বয়সে প্রেম, কলেজে পড়তে গিয়ে বয়সে বড় সহপাঠিনীকে বাবা-মা’র অমতে বিয়ে, বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় দুই ছেলে-সহ তাঁকে ডিভোর্স, বিধবা তুতো বোনকে দ্বিতীয় বিয়ে, তার আগে সেই বোনের মেয়ের সঙ্গে গভীর প্রেম— এতগুলি পর্ব আইনস্টাইনের জীবনে। কিন্তু আত্মজীবনী? নাহ্, তাতে ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ নেই সে-সবের। পড়লে মনে হয়, ও-সব আইনস্টাইনের জীবনে ঘটেনি, ঘটেছে অন্য কারও জীবনে। কেন এমন আত্মজীবনী লেখা? উত্তর খুঁজেছেন দুই আইনস্টাইন-বিশেষজ্ঞ— জেরুজ়ালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হ্যানখ গাটফ্রেয়ান্ড এবং বার্লিনের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিস্ট্রি অব সায়েন্স-এর ডিরেক্টর জারগেন রেন। ওঁরা দু’জনে সদ্য লিখেছেন— আইনস্টাইন অন আইনস্টাইন: অটোবায়োগ্রাফিকাল অ্যান্ড সায়েন্টিফিক রিফ্লেকশনস। এই বইয়ের সুবাদে জানা গেল, দু’বার আত্মজীবনী লিখেছিলেন আইনস্টাইন। ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর দু’সপ্তাহ আগে নিজের কলেজ জুরিখের সুইস ফেডারাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শতবর্ষ উপলক্ষে ছোট্ট আত্মজীবনী লিখেছিলেন তিনি। বইতে সেটির ইংরেজি অনুবাদ প্রথম ছাপলেন গাটফ্রেয়ান্ড এবং রেন।
যে আত্মজীবনীর কথা সবাই জানে, সেটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। তা আইনস্টাইন লিখেছিলেন দর্শনের অধ্যাপক পল আর্থার খিল্প-এর পীড়াপীড়িতে। খিল্প সম্পাদনা করেছিলেন জীবিত দার্শনিকদের নিয়ে খণ্ডে খণ্ডে বই— দ্য লাইব্রেরি অব লিভিং ফিলজ়ফার্স। সপ্তম খণ্ড হল, আলবার্ট আইনস্টাইন ফিলজ়ফার-সায়েন্টিস্ট। বার্ট্রান্ড রাসেল বা সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনকে নিয়েও ও-রকম খণ্ড। আইনস্টাইনের হাতে-লেখা আত্মজীবনীটি চটি। ছাপায় মাত্র ৪৬ পৃষ্ঠার। জার্মান ভাষায় শিরোনাম অটোবায়োগ্রাফিসখেস। জার্মান থেকে ইংরেজি ভাষান্তর খিল্পের। তাঁর দেওয়া শিরোনাম অটোবায়োগ্রাফিকাল নোটস।
যখন তা লেখেন, তখন আইনস্টাইনের বয়স ৬৭। সে কারণে ঠাট্টা করে প্রথম বাক্যেই তিনি জানিয়ে দেন, যেন লিখছেন নিজের ‘অবিচুয়ারি’। লেখা যে হবে অন্য রকম, তার ইঙ্গিত আইনস্টাইন দেন শুরুতেই। বলেন, তাঁর আগ্রহ নেই ‘নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপারে’। এমন মানুষ যে প্রথাগত আত্মজীবনী লিখতে বসেননি, বোঝা যায়। গাটফ্রেয়ান্ড ও রেন জানাচ্ছেন, আইনস্টাইন অন্যত্র বলেছিলেন, আত্মজীবনী প্রায়শ লেখা হয় নিজেকে উদগ্র ভালবাসা বা অন্যদের প্রতি অসদ্ভাব থেকে।
তা হলে কী লিখতে চান আইনস্টাইন? ব্যক্তিগত কিস্সার আগে ওই ‘নিছক’ বিশেষণটি ব্যবহার করে তিনি বুঝিয়ে দেন, তাঁর মতে আত্মজীবনী কী হওয়া উচিত। তিনি লিখতে চান আইডিয়া কী ভাবে আবিষ্কর্তার মাথায় আসে। এ প্রসঙ্গে বাল্যকালের দুটো অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আইনস্টাইন। প্রথম অভিজ্ঞতা: বাবা যে-দিন একটা কম্পাস কিনে আনলেন। যে দিকেই ঘোরাও কম্পাস, কাঁটা সব সময় উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। পাঁচ বছরের আইনস্টাইনের মনে হল, ব্রহ্মাণ্ডে কিছু কলকাঠি নড়ে অলক্ষ্যেই। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা ১২ বছর বয়সে। ‘পবিত্র’ জ্যামিতি বই পড়তে বসে— যুক্তি, শুধু যুক্তিই পারে অকাট্য সত্যের খোঁজ দিতে।
অটোবায়োগ্রাফিকাল নোটস-এ স্থানের উল্লেখ নেই মোটে। তবে, গাটফ্রেয়ান্ড ও রেন দেখিয়েছেন, কী ভাবে কাল বা সময় গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল অটোবায়োগ্রাফিকাল নোটস রচনাকে। আইনস্টাইন আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৪৬ সালে। এক বছর আগে হয়ে গিয়েছে হিরোশিমা-নাগাসাকি। সভ্যতা বিপন্ন। আইনস্টাইন উদ্বিগ্ন। ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপারের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন। তার সঙ্গে গাটফ্রেয়ান্ড এবং রেন অনুমান করেছেন, দুই বইয়ের পাঠ আইনস্টাইনকে অনুপ্রাণিত করেছিল আত্মজীবনী লেখার সময়। প্রথম বই জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক-এর সায়েন্টিফিক অটোবায়োগ্রাফি। দ্বিতীয়টি মহাত্মা গাঁধীর দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ। বই দু’টিই অস্থির সময়ে স্থির লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনি।