২০১৮ সালে ঝাড়গ্রামের গিধনিতে মৃত্যু হয় হাতিটির। (ডানদিকে) বাঁদরভুলা রেঞ্জে হাতির দেহ পোড়ানো হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র
ময়নাতদন্ত করতে করতেই রাত ১১টা হয়ে গিয়েছিল। সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। লাগারই তো কথা। দেহটা যে হাতির! ওই বিশাল দেহ। কয়েক টন ওজন। অত বড় দেহ একবার চিৎ করে এ পাশ করা তার পর আরেকটা প্রয়োজনে উল্টে দেওয়া সহজ কাজ নয়। কিন্তু কাজটা করতেই হবে। কারণ এক-একটি পরীক্ষার জন্য দরকারি দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিতে হচ্ছিল। আর সেই কাজটা করা খুব সহজ কথা নয়। বিশেষ করে যন্ত্রপাতি যদি হয় পুরনো। মহিষা, চুনারাম আর সাহেবরামের দলবল পুরনো পদ্ধতির যন্ত্রপাতি দিয়ে অনেক কষ্টে কাজ করে ফেলেছে। এবারের কাজ হল ওই বিশাল দেহখানি পোড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গত বছরের ঘটনা।
হাতির দেহ দাহ করা আর যজ্ঞের আয়োজন করা একই ব্যাপার। জোগাড় করতে হবে কেরোসিন, পোড়া মোবিল, সঙ্গে টায়ার। তার পর জোগাড় করতে হবে অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো কাঠ। এখানে অবশ্য হস্তিমেধ। জোগাড় করতে হবে অন্তত দু’ট্রাক শুকনো জ্বালানি কাঠ। তার পর সেই কাঠের চিতা সাজাতে হবে। আবার ওই বিশাল দেহটি তুলতে হবে সেই চিতায়। হাতিটা সেদিন সকালেই ঝাড়গ্রাম জেলার খেমাশুলি আর সরডিহা রেল স্টেশনের মাঝে ভোরের লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছে। সে খুব দুঃখজনক মৃত্যু। ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে রেলের ইলেকট্রিক খুঁটিতে ধাক্কা খায়। ধাক্কার অভিঘাত এত বেশি ছিল যে রেলের ওই শক্তপোক্ত খুঁটিও বেঁকে যায়।
জঙ্গলমহল শুধু নয়, সারা ভারতেই ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যু আজ বড় সমস্যার। কিন্তু এখানে সমস্যাটা একটু অন্য। সেটা পোড়ানোর সমস্যা। আজ থেকে প্রায় ১০-১২ বছর আগেও হাতি মারা গেলে আমরা, মানে বন দফতর, সেটিকে কবর দিতাম। কবর দেওয়ার জন্য মূলত লাগত নুন, ব্লিচিং পাউডার আর ফিনাইল। যদি হাতির দাঁত থাকত তাহলে কবর দেওয়ার আগে দাঁত কেটে ফেলতে হত। কোনও কোনও সময়ে প্রয়োজনে হাতির পা টুলের মতো উচ্চতায় কেটে ফেলা হত। দাঁত বা সেই পা বিভিন্ন মিউজিয়ামে বা প্রদর্শনীতে দর্শকদের জন্য রাখা থাকত।
সংরক্ষণ করা নমুনাগুলো খুবই প্রয়োজনের। হাতির দাঁত দেখে, পায়ের মাপ দেখে আন্দাজ করা যায় তার উচ্চতা, ওজন। হাতিটি পুরুষ না স্ত্রী সেই বিষয়-সহ বেশ কিছু তথ্য মিলত। কিন্তু এখন হাতি কবর দেওয়া হয় না,। হাতির দাঁত-সহ দেহের সমস্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু পোড়াতে গেলে পরিবেশের সর্বনাশ হয়। একটি পূর্ণ বয়স্ক হাতি পোড়াতে গড়ে ২৫০ কুইন্টাল জ্বালানি কাঠ লাগে। আর দেহ পোড়াতে কমপক্ষে প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা। এর সঙ্গে কেরোসিন, মোবিলের মতো জ্বালানিও থাকে। আবার পোড়াতে যদি টায়ার ব্যবহার করা হয় তাহলে তো আরও মুশকিল। নানা ভাবে পরিবেশ দূষণ। ওই পরিমাণ কাঠ জোগাড় করতে হলে কতগুলো গাছের প্রাণ যায়! তার পর সেই কাঠ পোড়ালে ধোঁয়ায় কতটা দূষণ হয়, চিন্তা করলেই তো খারাপ লাগে। তার উপরে হাতির চিতা বনাঞ্চলে সাজানো হলে বনেরও ক্ষতি হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। সরকারি নিয়ম।
২০০৬ বা ২০০৭ সালে কয়েকটি বন্যপ্রাণীর কিছু অঙ্গ বাদে বাকি সব বন্যপ্রাণীর যত ট্রফি, শরীরের অংশ বিভিন্ন দফতরে রাখা ছিল সেগুলি পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়। কেন ওইসব মূল্যবান নমুনাগুলো নষ্ট করে দেওয়া হয় তার সঠিক কারণ জানা নেই। চোরাশিকারিরা বন্যপ্রাণীর দেহের বিভিন্ন অংশ দেশীয় ও আন্তর্দেশীয় চোরাচালানকারীদের বিক্রি করে। সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ওই সব দ্রব্য সরকারি ভাবে কেনা-বেচা বা হেফাজতে রাখা বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও চোরাচালান হবে না। ফলে শিকারিদের বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ হবে। কারও মস্তিস্কপ্রসূত চিন্তা এমনই হতে পারে। আবার হাতির দেহ কবর দেওয়া বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে কর্তারা মনে করেছেন, কবর থেকে হাতির হাড়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোরাচালানকারীরা সংগ্রহ করতে পারে। পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া মানে কর্তারা নিশ্চিত আর দেহের কোনও অংশ নিয়ে কেউ চোরাচালান করতে পারবে না। তাদের দায়বদ্ধতাও থাকবে না।
চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণার জন্য, হাতে-কলমে পড়াশোনার জন্য মৃতদেহের একান্ত দরকার। ঠিক একই রকম ভাবে বুনো জন্তুদের মারা যাবার পর তাদের দেহ চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণার জন্য, নানান কাজে বা বিজ্ঞানের গবেষণার নানান কাজে অত্যন্ত জরুরি। তার জন্য দরকার সঠিক পরিকাঠামো, সদিচ্ছা ও আইন। যদি সব বন্য জন্তুদের মূল্যবান দেহের অংশ পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয় তবে সেগুলো আর ফিরে আসবে কি?
হাতে-কলমে পড়াশোনার জন্য জন্তুদের দেহের আর কি প্রয়োজন নেই? তা ছাড়া এই যে বিপুল জ্বালানি কাঠ হাতি পোড়াতে নষ্ঠ হয় সেটা পরিবেশের দূষণ তৈরি করে, সরকারি অর্থ নষ্ট হয়, এটা তো বন্ধ করা যায়। আগের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে আখেরে সকলেরই ভাল। সঙ্গে বুনো জন্তুর কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে রাখলে আগামী দিনের প্রজন্ম অন্তত একবার চোখে দেখার সুযোগ পাবে। বুনো জন্তুর এই মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে জেলার বন দফতরের অফিসেও তো জনসাধারণের জন্য রাখা যেতে পারে। তাতে ঠিক চিড়িয়াখানার মতোই, মারা যাওয়া বন্যজন্তদের একটা ধারণা আগামী প্রজন্মকে দেওয়া যাবে।
সংরক্ষণের গুরুত্ব কতটা? একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বছরে মায়ানমারের একটি বর্ষণবন থেকে প্রাকৃতিক ভাবে সংরক্ষণ হওয়া একটি ব্যাঙ মিলেছে। ব্যাঙটি গাছের রজনে আটকে অবিকৃত থেকে গিয়েছিল। জীববিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ব্যাঙটি ক্রিটেসিয়াস যুগের। যে যুগে ডাইনোসরেরা ঘুরে বেড়াত পৃথিবীতে। বিজ্ঞানীরা এত বছরের পুরনো ব্যাঙ পেয়ে উল্লসিত। গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে ওই ব্যাঙ।
কিন্তু মরা হাতি পুড়িয়ে সংরক্ষণ এবং প্রকৃতি সবদিক থেকেই ক্ষতি করা হচ্ছে। মরা হাতি লাখ টাকা। প্রবাদে বলে। হাতি পোড়ালে কিন্তু মরা হাতি লাখ টাকা খরচ করে।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক