মদের দোকানের বাইরে লাইন। ছবি: পিটিআই।
মাসাধিক কাল নির্জলা থাকিবার পর অবশেষে সরকারের তরফ হইতে মদের দোকান খুলিবার ছাড়পত্র মিলিয়াছে। এবং লকডাউনের বাজারেও মুক্তির সেই উল্লাস চাপা পড়ে নাই। কোথাও দোকান খুলিবার বহু পূর্ব হইতেই দীর্ঘ লাইন পড়িয়াছে, কোথাও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখিবার মহামন্ত্রটি সম্পূর্ণ ভুলিয়া ধাক্কাধাক্কি হইয়াছে, কোথাও আবার দোকান লুঠ হইতে পারে— এই আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা ঝাঁপ বন্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। বিষয়টি রসিকতার নহে। গভীর ভাবনার। উদ্বেগেরও। করোনা আতঙ্কে যখন দেশে তৃতীয় দফার লকডাউনের সূচনা হইয়াছে, বহু স্থানে শুধুমাত্র অত্যাবশ্যক পরিষেবা ভিন্ন অন্য কিছুই সচল রাখিবার অনুমতি মিলিতেছে না, সেখানে শুধুমাত্র সুরার প্রতি এহেন বদান্যতা কেন? কারণটি সম্পূর্ণতই অর্থনৈতিক। আবগারি শুল্ক বাবদ যে পরিমাণ অর্থ সরকারের ঘরে আসে, তাহা যথেষ্ট বড় অঙ্কের। গত বৎসর শুধুমাত্র মদ বেচিয়া রাজ্য সরকার আয় করিয়াছিল দশ হাজার কোটি টাকারও অধিক। স্বাভাবিক ভাবেই এই সঙ্কটকালে, যখন আয়ের অন্যান্য পথগুলি কার্যত বন্ধ, অথচ ব্যয়ের বোঝা বিপুল, তখন পর্যাপ্ত শুল্ক আদায়ের জন্য সরকারের নিকট ইহাই একমাত্র উপায়। এই বিষয়টিকে মাথায় রাখিয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যেই মদের উপর ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করিয়াছে। সুতরাং, মদের দোকান খুলিবার যুক্তিটি স্পষ্ট।
কিন্তু বিপদ অন্যত্র এবং একাধিক। গত কয়েক দিনে মদের দোকানে উপচাইয়া পড়া ভিড়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিধি কার্যত ধূলিসাৎ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ইহার ফলে সংক্রমণের গতি অত্যধিক বৃদ্ধি পাইবে। সুতরাং, রাজস্ব লাভের আশায় লকডাউনের সুফলগুলির জলাঞ্জলি ঘটিল কি না, ভাবিবার বিষয়। দ্বিতীয় সমস্যাটি নেশাজনিত। মদের নেশা অ-প্রতিরোধ্য। সেই কারণে দরিদ্রও হাতের যৎসামান্য অর্থ মদের পিছনে খরচ করে। এই অ-স্বাভাবিক সময়ে সমাজের একটি বড় সংখ্যক মানুষের হাতে এমনিতেই নগদ অর্থ নাই। কাজ হারানো অথবা বেতন না-পাওয়া মানুষের লক্ষণীয় সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়াছে। টান পড়িয়াছে পর্যাপ্ত খাবার কিনিবার সামর্থ্যে। এমতাবস্থায় নেশার সামগ্রী পাইবার পথটি খুলিয়া দিলে তাহার পরিণতি পরিবারের অন্যান্যদের পক্ষে মর্মান্তিক হইতে পারে। আরও একটি বড় বিপদ আছে— গার্হস্থ্য হিংসাবৃদ্ধি। লকডাউন-পর্বে ভারত-সহ সারা বিশ্বেই পারিবারিক হিংসা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাইয়াছে। আর্থিক অনিশ্চয়তাজনিত অবসাদের বিষফলটি ভোগ করিতেছে অগণিত নারী এবং শিশু। ইহার উপর মদের সহজলভ্যতা যোগ হইলে সেই সংখ্যা কোথায় পৌঁছাইবে, ভাবিলে শিহরিত হইতে হয়। কারণ, মদের সঙ্গে পারিবারিক হিংসার গভীর সম্পর্কটি ইতিমধ্যেই প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
এই হিংসা রুখিবার দায়িত্ব অবশ্যই পুলিশ-প্রশাসনের। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েই যাহা সম্ভব হয় নাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাহা সুষ্ঠু ভাবে পালিত হইবে, এমন আশা করাই বাতুলতা। মদ বিক্রি বৃদ্ধি পাইলে সরকারের হাতে কিছু অর্থ আসিবে ঠিকই। কিন্তু সমাজের গতি কোন দিকে হইবে? সুফলের তুলনায় কুফলের পাল্লা ভারী হইলে সিদ্ধান্তটির যৌক্তিকতা প্রশ্নের মুখে পড়িবার কথা। পড়িতেছে কি?
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)