পরিচয়হীন? নাগরিকত্ব প্রমাণের অপেক্ষায়, ইম্ফল
বিদেশিদের আটকে রাখতে আপাতত ছ’খানা ডিটেনশন সেন্টার বা বন্দিশিবির রয়েছে অসমে, আরও দশটা তৈরির পরিকল্পনা করছে সে রাজ্যের সরকার। তা করা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি-র সমান্তরাল প্রক্রিয়া হিসেবে। যে শহর বা জেলাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন পোস্ট আছে, সেই সব ক’টা জায়গায় বন্দিশিবির তৈরির নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। আসলে, আটকের যে ম্যানুয়াল বা নির্দেশিকা সরকার দিয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই দাবি।
অসমে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ল। এঁদের নিয়ে কী করা হবে, স্পষ্ট করে বলেনি আদালত। যাঁরা বাদ পড়েছেন, পরের ধাপ হিসেবে ফরেনার্স বা বিদেশি ট্রাইবুনালে তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে।
অবশ্য, উন্মত্তের মতো বিদেশি খোঁজার ব্যাপারটা অসমে নতুন নয়। সর্বশেষ এনআরসি-র আগেও সে রাজ্যে ‘সাসপেক্টেড ফরেনার্স’ বা সম্ভাব্য বিদেশি খুঁজে ট্রাইবুনালে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চালু ছিল। অসম জুড়ে মোট ১০০টা বিদেশি ট্রাইবুনাল আছে। এর মধ্যে ৬৪টা তৈরি হয়েছে ২০১৬ সালে। বহু ঘটনাই বিদেশি ট্রাইবুনালের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন বা সীমান্ত পুলিশ।
আশ্চর্য, যে ব্যক্তিকে বিদেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, প্রমাণ করার দায় কিন্তু তাঁর নিজেরই! ২৪ মার্চ ১৯৭১-এ অসমের ভোটার তালিকা বা ১৯৫১’র এনআরসি তালিকায় তাঁদের বা তাঁদের পূর্বপুরুষের নাম ছিল— এই নথি দেখাতে হয়। আলাদা নথিতে আলাদা বানান থাকলে কিংবা জেরার সময় বলা তথ্য লেখার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেই কাউকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এর ফলে তাঁকে বিদেশিও ঘোষণা করা হয়ে যেতে পারে, যতই তা করণিকের ত্রুটি হোক না কেন। প্রমাণ করার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বলে তদন্ত-প্রক্রিয়াও খুব ঢিলেঢালা। ২০১৩ সালে ‘অসম রাষ্ট্র’ বনাম ‘মোসলেম মণ্ডল’ মামলার পুনর্বিবেচনার আর্জি শোনার সময় এই শৈথিল্যের কথা উল্লেখ করেছিল গুয়াহাটি হাইকোর্ট। সংবিধানের ১৪ নং ধারার উল্লেখ করে সে সময়ই সতর্ক করেছিল আদালত। এই ধারায় ন্যায়বিচারের গুরুত্বের কথা বলা আছে। ২১ নং ধারায় প্রত্যেক নাগরিক ও অনাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা থাকলেও ন্যায্য প্রক্রিয়া, বিচার ও কার্যধারার সমস্ত সাংবিধানিক রক্ষাকবচ এই ট্রাইবুনালে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, নাগরিকত্বই হল মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সেই সূত্রেই তাঁর অন্যান্য অধিকার মেলে।
ট্রাইবুনাল যদি কাউকে বিদেশি বলে দেয়, তা হলে সাধারণত তাঁকে প্রথমে বন্দিশিবিরে রাখার এবং পরে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বছরের অগস্টের হিসেব বলছে, অসমের ছ’টা ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রয়েছেন ১১৪৫ জন, যাঁদের মধ্যে ৩৩৫ জন তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে বেশির ভাগই জানেন না, কী দোষে তাঁদের অপরাধী ও বিচারাধীন বন্দিদের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। গ্রেফতারের সময় তাঁরা সকলেই চমকে গিয়েছিলেন, কেননা ট্রাইবুনালে তাঁদের বিরুদ্ধে চলা প্রক্রিয়ার ব্যাপারেই তাঁরা অবগত ছিলেন না! যে হেতু কাউকে কত দিন আটকে রাখা যাবে তার বিধিবদ্ধ মেয়াদ নেই, অতএব তাঁরাও তা জানেন না। আটকের নিয়মিত পর্যালোচনার ব্যবস্থাও নেই। কিছুটা উপশমের বন্দোবস্ত অবশ্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। হর্ষ মন্দরের করা জনস্বার্থ মামলায় ১০ মে তারা রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, তিন বছর বা তার বেশি সময় ধরে আটক থাকা ব্যক্তিদের শর্তাধীন মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু তাঁদের আর্থিক জামিন দিতে হচ্ছে, যা সহজ হচ্ছে না।
আসলে অসমের ক্ষেত্রে আটক করাটা হল সহজ বিকল্প। ১৯৪৬-এর বিদেশি আইন অনুসারে হেফাজতে না রেখে অন্য ব্যবস্থারও নিদান আছে। যেমন, চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনের সামনে নিয়মিত হাজিরা, বিশেষ কার্যকলাপ বা ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশায় বাধা ইত্যাদি। ২০১২ সালে ‘বিদেশি বিষয়ক শ্বেতপত্র’-এ আটকের ক্ষেত্রে ‘বিদেশি’দের চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিল অসম সরকার, যাতে তারা ‘উধাও’ না হয়।
আটকদের সঙ্গে পরিবারের যোগ ক্ষীণ। কয়েক মাস আগেও অনেকের পরিবার আলাদা আলাদা বন্দিশিবিরে ছিল। কারাগারের মধ্যেই মায়ের সঙ্গে বড় হয়ে উঠছে ছেলেমেয়েরা— যে যার মতো, আলাদা আলাদা ভাবে। স্কুলের পর বাচ্চাদের কারাগারে ফিরিয়ে আনা হয়। মেয়েরা মায়ের সঙ্গে থাকার অনুমতি পেলেও ছেলেদের বয়স ছয় পেরোলেই তাদের বন্দিশিবির থেকে বার করে দেওয়া হয়। কারাগারের খাঁচার ভেতর থেকে তারা বেরোতে পারে বটে, কিন্তু তাদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রায় কখনওই কাউকে পাওয়া যায় না। এ সবই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের বিরোধী। আর, রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে কিন্তু শিশু অধিকার নিয়ে সর্বাধিক স্বার্থরক্ষার নীতিকে সমর্থন করে ভারত।
আটক থাকার ফলে অনেকেই মানসিক ও শারীরিক অসুখে ভোগেন। চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল, বিনোদনের ব্যবস্থাও সীমিত। অভিযুক্ত, বিচারাধীন ও আটকদের আলাদা করার ব্যবস্থা নেই। তাঁদের সঙ্গে কাজ করা এক চিকিৎসক জানাচ্ছেন, কারাগারে ভিড় অবশ্যম্ভাবী, তাই বেশির ভাগ আটক ব্যক্তিই মানসিক অসুখের শিকার। মেডিক্যাল ক্যাম্পের ব্যবস্থা অথবা সাইকোসিস আক্রান্তদের হাসপাতালে পাঠানো হলেও বন্দিশিবিরের পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্যের সহায়ক নয়। আটকদের সঙ্গে অপরাধীর মতোই আচরণ করেন কারাগার কর্মীরা। আটক থাকা এক জনের কথায়, “মেয়েরা খুব কাঁদত। তাদের খিদে পেত, চা-পানি যথেষ্ট ছিল না। ভয়ানক দুঃখের পরিবেশ। বাড়ি থেকে কত দূরে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের। বাইরের জিনিস ঢোকা বা লোকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও মিলত না।”
আটক বা কারাবন্দিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠালে সঙ্গে যেত রিজ়ার্ভ পুলিশ এবং কারাগার কর্মীরা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আটক ব্যক্তিদের হাতকড়া পরানোর নিয়ম ছিল না, কিন্তু ‘এসকর্ট’রা তা করতে পারত! এমনকি, আটক রোগীকে হাসপাতালের বেডে হাতকড়া পরিয়ে রাখার উদাহরণও আছে, যা সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন লঙ্ঘন করে।
কারাগারের মধ্যে ছ’খানা বন্দিশিবির অসম কারা দফতরের নিয়ম অনুসারে চলে। কিন্তু অভিযুক্তদের মতো কারাগারের ভেতর কাজের সুযোগ পান না আটকেরা। প্যারোলের জন্যও বিবেচিত হন না। এ যেন এক রকম ঝুলে থাকা। সে কারণেই কর্তৃপক্ষের অসংখ্য অলিখিত কানুনের শিকার হন— অধিকারহীনতা, অপমান এবং নারকীয় পরিবেশে নাগরিকত্ব মুছে দেওয়াই যেন তাঁদের পাওনা। আমাদের নাকের ডগায় তৈরি হওয়া এই শিবিরগুলো কিন্তু ১৯৪৮ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা এবং ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক গোষ্ঠীর মত, অবৈধ অভিবাসীদের আটকের ঘটনা ব্যতিক্রম, আইন নয়। অনির্দিষ্ট কাল আটকে রাখাও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।
দু’বছর ধরে কোকরাঝাড়ের বন্দিশিবিরে আটক ছিলেন বীণারানি সাহা। তাঁর কথায়, “আমরা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিলাম। কুকুর-বেড়াল ঢুকতে পারত না। মনে পড়ে, ওখানে অনেক লোক ছিল। মেঝেতে চাদর পেতে শুতাম। সবাই পর পর সারি বেঁধে থাকতাম।”
ওই শিবিরে থাকা রহিমা বিবি জানান, “একটা ঘরে আমরা ৫০ থেকে ৭০ জন ছিলাম। সবাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছিল।” মাতৃত্বকালীন অবস্থায় বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছিল রোশমিনারাকে। সেখানেই সন্তানের জন্ম হয়। পরিবারের কারও নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা ৩০।
প্রতি দিন এক অবিশ্বাস্য আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন আটকেরা। দর্শনবিদ হানা আরেন্ট এক বার লিখেছিলেন, কী ভাবে মানুষ ঘরহীন থেকে রাষ্ট্রহীন থেকে অধিকারহীন হয়ে যান। পরিণত হন ‘পৃথিবীর পাঁক’-এ (স্কামস অব দি আর্থ)।
অসমের ট্রাইবুনাল এবং বন্দিশিবিরে এখন ঠিক এই কাজটাই চলছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে ডিটেনশন সেন্টার বিষয়ক রিপোর্ট-লেখক