আমপানের আঘাতে কত বাড়ি ভাঙিয়াছে, সেই গণনা সম্পূর্ণ হইলে আর একটি হিসাব মিলিবে— দরিদ্রের জন্য পাকা বাড়ি জোগাইবার প্রতিশ্রুতিতে কতখানি ফাঁক রহিয়া গিয়াছে। সকল জেলা হইতেই যে চিত্র মিলিয়াছে তাহা এই যে, প্রধানত বসবাসের অযোগ্য বাড়িগুলিকেই ধূলিসাৎ করিয়াছে ঝড়। মাটি, বাঁশ, খড়, টিন, টালি, প্লাস্টিকে কোনও মতে নির্মিত ওই বাড়িগুলি নিরাপদ আশ্রয়, এমন দাবি কেউ কখনও করে নাই। অতএব ঝড়ে-বন্যায় গ্রামের পর গ্রাম মানুষ নিরাশ্রয় হইবে, মাথা বাঁচাইতে ত্রিপলের খোঁজ পড়িবে, তাহাতে আক্ষেপ যতই থাক, আশ্চর্যের কিছু নাই। এই সব ঘরের বাসিন্দারাও বিস্মিত হইয়া সময় নষ্ট করেন নাই, তাঁহারা সত্বর পুনরায় ঘর নির্মাণের কাজে লাগিয়া পড়িয়াছেন। তাঁহাদের ঘর আচ্ছাদন করিবার ত্রিপল বা প্লাস্টিক, টিনের পাত কিংবা টালি সুলভে জুগাইতে নানা ব্যক্তি ও সংগঠন আগাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু প্রশ্নটি থাকিয়াই গেল— এই মানুষগুলি কি ফের তেমন কাঁচা ঘরেই থাকিবেন? দরিদ্রের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের আবাসন প্রকল্পগুলির কী হইল তবে?
গত পাঁচ-সাত বৎসরে গ্রাম ও শহরে স্বল্পবিত্ত মানুষকে ঘর জুগাইবার প্রকল্পগুলি বার বার নাম বদলাইয়াছে। কেন্দ্রের ইন্দিরা আবাস যোজনা হইয়াছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা। রাজ্যে ‘আমার ঠিকানা’ প্রকল্প নাম বদলাইয়া হইয়াছিল ‘গীতাঞ্জলি’, এখন তাহা বাংলা আবাস যোজনা। কিন্তু রাজ্যবাসীর একটি বড় অংশের ভাগ্য তাহাতে বদলায় নাই। যে কোনও দুর্যোগে তাঁহাদের কাঁচা ঘর ভাসিয়া যায়, আবার তাহা বাঁধিতে হয়। আয়লায় যাঁহারা ঘর হারাইয়াছিলেন, তাঁহাদের একাংশ আমপানে ফের ঘর হারাইলেন।
প্রধানমন্ত্রী ২০২২ সালের মধ্যে সকল দেশবাসীর জন্য পাকা ঘরের অঙ্গীকার করিয়াছেন, শুনিলে আমপান-আক্রান্তদের মুখে হয়তো ক্লান্ত হাসি ফুটিবে। এখনও কত পাকা ঘরের প্রয়োজন, তাহার হিসাব করিবার কাজটা সহজ হইবে না। ২০১১ সালের গৃহস্থালি গণনা দেখাইয়াছিল, গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে ঘাস-খড়-বাঁশ প্রভৃতির দ্বারা নির্মিত ছাদ-যুক্ত গৃহ ১৯ শতাংশ, আর ওই সকল উপকরণে নির্মিত দেওয়াল-যুক্ত গৃহ ৬২ শতাংশ। পরবর্তী দশ বৎসরে বিভিন্ন আবাস প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দ হইয়াছে, গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র কমিবার ইঙ্গিতও মিলিয়াছে। অতএব পাকা গৃহের মালিকানায় পূর্বের অপেক্ষা উন্নতি হইয়াছে, এমন ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে। কিন্তু, যাঁহারা আজ পলিথিনের আচ্ছাদনে দিন কাটাইতেছেন, জনসংখ্যায় তাঁহাদের অনুপাত কষিতে বসা নিরর্থক। বরং তাঁহাদের বিপন্নতা দিয়া সরকারের কাজের বিচার করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে হিঙ্গলগঞ্জের সেই স্কুলছাত্রীকে, যে ঝড়ের মুখে সপরিবার আশ্রয় লইয়াছিল শৌচাগারে, কারণ সেইটিই তাহাদের গৃহের একমাত্র পাকা ঘর। করোনাভাইরাস এবং আমপান, এই দুই দুর্যোগ পুনরায় যথাযোগ্য বাসগৃহকে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ভিত্তি বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিল। পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য যথাযোগ্য গৃহের অভাব, সুন্দরবনের ন্যায় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় উপযুক্ত বাসস্থানের অভাব, এইগুলি কেবল দরিদ্রের সমস্যা নহে। ইহা সামাজিক সঙ্কট। মানব উন্নয়নে বিনিয়োগের অপচয় হইবে, যদি বাসগৃহ নিরাপদ না হয়।