অতিমারির মোকাবিলায় প্রশাসনিক স্তরে সমন্বয়ের কাজটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রোগ চিহ্নিতকরণ এবং তাহাকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখিবার পর্যায়গুলি সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন না হইলে, সংক্রমণ দ্রুত ছড়াইবার আশঙ্কা থাকে। পশ্চিমবঙ্গ যে সেই কাজে পিছাইয়া আছে, তাহা বলা চলে না। মোদী সরকার যতই পশ্চিমবঙ্গের ‘ভয়ঙ্কর’ অবস্থা লইয়া উদ্বিগ্ন হউক, বাস্তব ইহাই যে, উৎসবের মাস অতিক্রান্ত হইলেও এবং লোকাল ট্রেন চালুর পরেও রাজ্যে সংক্রমণের সংখ্যা বিপুল গতিতে ঊর্ধ্বগামী হয় নাই। ইহা কম কথা নহে। অনেক রাজ্যে, এমনকি খাস রাজধানী অঞ্চলে, পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগবহ। তবে তুলনামূলক আলোচনার কাঠামো হইতে বাহির হইয়া আসিলে বলিতেই হয়, পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয়তার অভাবের চিহ্নটিও স্পষ্ট। যেমন, সম্প্রতি কলিকাতায় কন্টেনমেন্ট জ়োন-সংক্রান্ত ঘোষণার মধ্যে যে পরিকল্পনা এবং সমন্বয়ের অভাব দেখা যাইল, তাহা এই পর্যায়ে একেবারেই কাম্য নহে। একে তো কলিকাতায় নূতন করিয়া তিনটি অঞ্চলকে গণ্ডিবদ্ধ করিতে হইয়াছে। তদুপরি অভিযোগ, সেই গণ্ডি টানিতেও অতিবাহিত হইয়াছে দুই সপ্তাহ। ইতিমধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা সংক্রমণ-মুক্ত হইয়াছেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠিয়াছে, সংক্রমণের গোড়ায় বাঁধ না দিয়া, এত পরে ব্যবস্থা করিলে উদ্দেশ্য পূরণ হইবে কী উপায়ে?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। অতিমারি বারংবারই প্রমাণ করিয়াছে, সাফল্য পাওয়া আর সেই সাফল্য ধরিয়া রাখা এক কথা নহে। কেরল তাহার সর্বোত্তম উদাহরণ। সংক্রমণ রুখিতে সারা দেশ যখন দিশাহারা, তখন দক্ষিণের এই রাজ্য অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতায় সংক্রমণের বিস্তার রুখিয়াছিল। কিন্তু সেই সাফল্য ধরিয়া রাখা যায় নাই। ওনামের সময় প্রশাসনিক শিথিলতার চরম মূল্য দিয়াছে। ইউরোপ, আমেরিকায় সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা পরিকাঠামোযুক্ত দেশগুলিও পূর্ব পরিকল্পনার অভাব এবং প্রশাসনিক ঔদাসীন্যের মাসুল গনিতেছে। ইউরোপ দ্বিতীয় বার লকডাউন ঘোষণা করিয়াছে, আমেরিকায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।
পশ্চিমবঙ্গেরও আত্মতুষ্টির জায়গা নাই। যাবতীয় ঢিলামি অবিলম্বে ঝাড়িয়া ফেলিয়া করোনা মোকাবিলার সঙ্গেই সমান যত্ন লইতে হইবে স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্য অবহেলিত ক্ষেত্রগুলির প্রতি। সম্প্রতি অভিযোগ উঠিয়াছে, অর্থাভাবের কারণে সরকারি হাসপাতালগুলি ঔষধ, গ্লাভস, গজ, ব্যান্ডেজের ন্যায় চিকিৎসার সাধারণ সামগ্রীগুলিও ক্রয় করিতে পারিতেছে না। সরকার পেসমেকার-সহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহকারী সংস্থাগুলির প্রাপ্য অর্থ মেটায় নাই। অথচ, স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, টাকার অভাব নাই। ত্রুটি যাহা কিছু, তাহা স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরে। কেন সরকারি হাসপাতালগুলির হাতে এই পরিমাণ টাকাও থাকিতেছে না, যাহাতে তাহারা প্রয়োজনীয় গজ, ব্যান্ডেজটুকু ক্রয় করিতে পারে, তাহা দ্রুত সন্ধান করিয়া উপযুক্ত ব্যবস্থা করিতে হইবে। কন্টেনমেন্ট জ়োনগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রশাসনকে আরও তৎপর, গতিশীল হইতে হইবে। এই দুর্দিনে— মুখের কথায় নহে, কাজের মাধ্যমে নাগরিকের কাছে প্রমাণ দিতে হইবে, সরকার তাহাদের পার্শ্বেই আছে।