প্রতীকী ছবি।
পূজা আসিয়া গেল, মুখ্যমন্ত্রী ‘দর্শন’ অবধি সারিয়া ফেলিলেন, অথচ ডেঙ্গি-অসুর বধ হইল না। অনুমান করা চলে, পূজার অযুত প্রদীপের নীচে ডেঙ্গির অন্ধকারটিও থাকিবে। শরতের বারো আনা কাটিয়া যাওয়ার পরও বর্ষণ অব্যাহত। তাহাতেই ডেঙ্গি ভীতিপ্রদ হইয়াছে। সরকারি হিসাবে রাজ্যে ১৯ জন প্রাণ হারাইয়াছেন, আক্রান্ত এগারো হাজারেরও অধিক। গত দুই সপ্তাহে কেবল কলিকাতা শহরে প্রতি দিন গড়ে ৪০ জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু মিলিতেছে। স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা কিন্তু বলিয়াছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। শুনিয়া রাজ্যবাসী স্তম্ভিত— এতগুলি মৃত্যু, এত আক্রান্ত, নিয়ন্ত্রণ তবে হইল কী হিসাবে? সংবাদে প্রকাশ, ২০১৭ সালে আক্রান্তদের সংখ্যা যেমন লাগামছাড়া হইয়াছিল, এ বৎসর এখনও তেমন হয় নাই। গত বৎসর এই সময়ে আক্রান্তের হার ছিল অধিক, অতএব এ বৎসর অবস্থা ‘নিয়ন্ত্রণে’— সরকারি যুক্তির এমনই চলন। সাধারণ বুদ্ধিতেও কথাটা গ্রহণযোগ্য বলিয়া বোধ হয় না। গত বৎসর বর্ষা এত বিলম্বিত হয় নাই। বৃষ্টি শেষ হইবার পর জমা জলে মশার বংশবৃদ্ধি, এবং তাহার পরে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি প্রভৃতির সংক্রমণ, এই চক্রই প্রত্যাশিত। ফলে দিনপঞ্জিকার হিসাবে সময় এক হইলেও, ঋতুর নিরিখে এখনও সর্বাধিক সংক্রমণের সময় আসে নাই। অতএব গত বছরগুলির তুলনায় এ বৎসর ডেঙ্গির উপর ‘নিয়ন্ত্রণ’ বাড়িয়াছে কি না, সে কথা বলিবার সময় এখনও আসে নাই। দ্বিতীয়ত, যে কোনও সংক্রামক রোগ ‘নিয়ন্ত্রিত’ হইয়াছে কি না, তাহা নির্ধারণ করিবার একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি পর পর কয়েক বৎসরের সংক্রমণের হারের ভিত্তিতে তাহার হিসাব করে। গত বৎসরের তুলনায় এ বৎসর সংক্রমণ কম হইলেও তাহা ‘নিয়ন্ত্রণে সাফল্য’ বলিয়া দাবি করা চলে না।
রাজ্যের সাফল্যের দাবি প্রতিষ্ঠা হইবে কী প্রকারে? এ বৎসরও কেন্দ্রকে পতঙ্গবাহিত রোগের সংক্রমণ বিষয়ে কোনও তথ্য দেয় নাই রাজ্য। সকল রাজ্যের মধ্যে এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গই ব্যতিক্রম। দুর্জনে বলিবে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার প্রশাসনের ব্যর্থতার বিন্দুমাত্র সাক্ষ্য রাখিতে চান না। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের মশা হইতে রাজ্যবাসীকে সতর্কও করিয়াছিলেন। সীমান্তের ওপার হইতে অসুখ আমদানি হইতেছে কি না, তাহা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তথ্যের অভাব যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রুটির মূল্যায়ন অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং তাহাতে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে রাজ্যবাসী, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। রাজ্য সরকার লুকাইতে চাহিলেই প্রকৃত চিত্র গোপন থাকিবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে যে চারটি রাজ্য ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সকলের পশ্চাতে, সেগুলির মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং ঝাড়খণ্ডের সহিত রহিয়াছে পশ্চিমবঙ্গও। ম্যালেরিয়ার মশা যাহারা নিয়ন্ত্রণ করিতে ব্যর্থ, তাহারা ডেঙ্গি কিংবা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে সফল হইবে, সেই সম্ভাবনা কতটুকু? জনস্বাস্থ্য একটি সার্বিক বিষয়। সম্বৎসর তাহার জন্য পরিকল্পিত কর্মসূচি প্রয়োজন। প্রথম প্রয়োজন যথাযথ তথ্য।
পুরসভাগুলি সত্যই তৎপরতর হইয়াছে। ডেঙ্গি প্রতিরোধের কার্যসূচি গ্রহণ করিয়াছে, পুর প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে কর্মীও নিযুক্ত হইয়াছে। কিন্তু জলে মশার লার্ভা পরীক্ষা কিংবা বাড়ি বাড়ি সমীক্ষার মতো ধরাবাঁধা কিছু কাজেই সে উদ্যোগ সীমাবদ্ধ। আবর্জনা অপসারণ, প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিরোধ, জমা জল সরাইবার কাজগুলি করিবে কে? আক্ষেপ, মুখ্যমন্ত্রীর ন্যায় তাঁহার অধীনস্থ কর্তারাও সতত সীমান্তের অপর দিকে অঙ্গুলি তোলেন। কখনও রেল, কখনও অপর কেন্দ্রীয় সংস্থা, কখনও বা গৃহস্থকেই দায়ী করিয়া নিজেদের ‘নিরপরাধ’ প্রমাণ করেন। রাজ্যব্যাপী পূজার আনন্দের মধ্যে যাঁহাদের ঘরে ডেঙ্গির অন্ধকার, এই যুক্তিগুলিতে তাঁহাদের শুশ্রূষা হইবে তো?