কোপ: জঙ্গির হাতে নিহতকে স্মরণ করতে গির্জার সামনে জড়ো হয়েছেন নাগরিকরা, নিস, ফ্রান্স, ৩১ অক্টোবর। এএফপি
গত ২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের নিস শহরের বড় গির্জা নোত্রদাম বেসিলিকায় এক আততায়ী ঢুকে পড়ে উপর্যুপরি তিন জনকে খুন করে। এর কিছু দিন আগে প্যারিসের নিকটবর্তী অঞ্চল ইভলিনে নৃশংস ভাবে এক ইস্কুল শিক্ষকের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিল এক চেচেন তরুণ। অপরাধ— তিনি নাকি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাখ্যার সূত্রে ক্লাসে মহম্মদকে নিয়ে শার্লি এবদো-র ব্যঙ্গচিত্রটি দেখিয়েছিলেন। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ ফ্রান্সে যে সন্ত্রাসের বাতাবরণ চলছে, তাতে ব্যঙ্গচিত্রের ভূমিকা খাটো করে দেখা যায় না। ঘটনাটি আবার ঘটল একটি গুরুত্বপূর্ণ খ্রিস্টান পরবের আবহে। সব টুকরো ঘটনাকে এক জায়গায় করলে একটা আঘাত-প্রত্যাঘাতের ছবি ভেসে ওঠে। এক দিকে ব্যঙ্গচিত্রে পরধর্মের নিন্দা বা ব্লাসফেমি, তার বিপরীতে সালাফিতান্ত্রিক মৌলবাদ। বিপরীতমুখী দুই বিশ্বাসতন্ত্রের সংঘাত।
ফরাসি সমাজে এর অভিঘাত বড় গভীর। ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ানটি মৌলিক ও মূলস্পর্শী। মনে হতে পারে, কিছুটা উস্কানিমূলকও। সেখানে অধিকার বা স্বাধীনতার ভূমিকা খুব জোরালো। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ— ধার্মিক বা অধার্মিক হওয়ার, দেবনিন্দা বা দেবস্তুতি করার পূর্ণ স্বাধীনতা। দ্বিতীয়ত, ধারণাটির মধ্যে বন্ধনমুক্তির স্পৃহাটিও খুব স্পষ্ট। বিশেষ ভাষা, গোষ্ঠী বা ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে অন্য পরিচিতি খুঁজে পাওয়া, ভিক্তর উগো-র কথায় ‘মানবতার দেশ’ খুঁজে পাওয়া। ধর্মনিরপেক্ষ বিবাহ মানে শুধুমাত্র বিবাহের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিহার নয়, বিবাহের মাধ্যমে দুই মুক্ত মানুষের মিলিত হওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা। এর উপর খোদার খবরদারি অবাঞ্ছিত। এর ফলে বিবাহের ধারণাটি আরও বিস্তৃত হয় এবং বহুত্ব অর্জন করে। সমপ্রেমের বিবাহ মান্যতা পায়। ক্যাথলিক ধর্মের বিপরীতে গিয়ে বাড়ির পুরুষ-কর্তার ভূমিকাটি নিন্দিত হয় এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যে কোনও কার্টুন-কাণ্ড আসলে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কষ্টিপাথর। গোঁড়ামি কৌতুক সহ্য করতে পারে না। যে সব দেশে লিবারাল গণতন্ত্র সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়, সেখানে এহেন ব্যঙ্গবিদ্রুপ থেকে জেল-জরিমানার অনেক নজির আছে। তাইল্যান্ডে কার্টুন-কাণ্ডের ফলে পঁচিশ বছর জেল হওয়ার ঘটনাও অজানা নয়। বিপরীতে, পূর্ণ গণতন্ত্রে কৌতুক বা স্যাটায়ার, শুধু এক নাগরিক অধিকার নয়, নাগরিক কর্তব্যও বটে। সেই কার্টুনের ফলে যখন ব্যক্তির উপর ছুরিকাঘাত নেমে আসে, তখন আসলে আক্রান্ত হয় ধর্মনিরপেক্ষতার বহুত্ববাদ। ইসলাম ধর্মের নামে যারা এই আঘাত নামিয়ে আনছে, ফরাসি সমাজের চোখে তারা ‘ইসলামো-ফ্যাসিস্ট’। এই নব্য ইসলাম আসলে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের নামান্তর।
শুধু প্রতীকী বা সাংস্কৃতিক স্তরে নয়, রাজনৈতিক স্তরেও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অভিঘাত সুদূরপ্রসারী। এবং আরও বেশি উদ্বেগের। এই সন্ত্রাসবাদের প্রতিষেধক হিসেবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে এমন দাওয়াই প্রয়োগ করতে হচ্ছে, যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিসরকে ক্রমশ সঙ্কুচিত করে ফেলছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিণত হচ্ছে পুলিশ-রাষ্ট্রে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার খাতিরে এমন কিছু আইন চালু করতে হচ্ছে, যার ফলে নাগরিক স্বাধীনতার উপর নেমে আসছে কাঁচির কোপ। অর্থাৎ, নাগরিক-সুরক্ষার দিকে জোর দিতে গিয়ে নাগরিকের গা থেকে একে একে খুলে ফেলা হচ্ছে স্বাধিকারের কবচকুণ্ডল। ২০১৫-য় শার্লি এবদো-র কার্টুন-কাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় প্যারিসে সন্ত্রাসবাদী হামলা হল। সে দিন সন্ধেতেই ফ্রান্সে জারি হল জরুরি অবস্থা। বলা হল, নাগরিক স্বাধীনতার প্রথম শর্ত, তার জীবনকে সুরক্ষিত রাখার অধিকার। তার পর ২০১৬-য় নিস-এ সন্ত্রাসবাদী ট্রাক-হামলার পর জরুরিবিধির পরিসরকে আরও বিস্তারিত করা হল। এ ভাবে উপর্যুপরি সন্ত্রাস-আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় জরুরি অবস্থা ফরাসি সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। নতুন আইনের দৌলতে প্রায় বিনা ওয়ারেন্টেই পুলিশ বাড়ি তল্লাশ করতে পারে, ফোনে আড়ি পাততে পারে, যে কোনও সন্দেহভাজনকে নজরবন্দি বা গৃহবন্দি করে রাখতে পারে। এর ফলে, মানুষের জীবন সত্যি কতটা সুরক্ষিত থাকছে বোঝা মুশকিল, মানুষের যাপন যে ক্রমশ অরক্ষিত হচ্ছে, এ কথা বিলকুল বলা যায়।
অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিষয়ক জরুরি অবস্থা তো জারি ছিলই, গোদের উপর বিষফোড়ার মতো তার সঙ্গে এই করোনা-আবহে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা। ফ্রান্সে এখন আছড়ে পড়েছে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ। চলাফেরা, মেলামেশা, উৎসব উদ্যাপন ইত্যাদির উপর নানান সরকারি বিধিনিষেধের চাপে ফরাসি নাগরিকের নাভিশ্বাস উঠেছে। এক দিকে কোভিডের হুমকি, অন্য দিকে সন্ত্রাসবাদের আস্ফালন, এই জোড়াফলার সামনে বিপর্যস্ত নাগরিক জীবন।
শিক্ষক-হত্যার পর স্বয়ং মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে শার্লি এবদো-র প্রসঙ্গ অবধারিত টেনে আনেন। দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ফ্রান্স মতপ্রকাশ ও ব্যঙ্গচিত্র নির্মাণের স্বাধীনতাকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে, যে কোনও মূল্যে রক্ষা করবে তার ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধকে। এই ভাষণেই যেন আগুনে ঘিয়ের ছিটে পড়ে। গোটা মুসলিম দুনিয়া ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। তুরস্ক, ইরান, জর্ডন, কুয়েত ইত্যাদি দেশ থেকে সরকারি পর্যায়ে বয়কটের ডাক ওঠে। বিভিন্ন দেশের সুপারমার্কেট থেকে ফরাসি পণ্য অপসৃত হয়। পশ্চিম এশিয়ার এ সব দেশে ছড়িয়ে আছে বিশেষত ফরাসি কৃষি-খাদ্যপণ্যের এক বিপুল বাজার। পণ্য সরবরাহে ছেদ পড়লে সমূহ বাণিজ্যিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা। সুচিন্তিত এই প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট হয় যে, শিক্ষকের মুণ্ডচ্ছেদ বা নিস-এর হত্যাকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস নয়। বরং, এর পিছনে রয়েছে এক সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত।
প্রেসিডেন্ট মাকরঁ ও তাঁর সরকার জানিয়েছে, এই বৈশ্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনও আপস নয়। ‘দ্রুত’ ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ‘ভয় শিবির বদল করে’ বক্তৃতায় বলেছেন তিনি। শোনা যাচ্ছে, নিস-কাণ্ডের কারিগর এক জন টিউনিসিয়ার নাগরিক। অবৈধ ভাবে ফ্রান্সে প্রবেশকারী। অতএব সীমান্তে নজরদারির উপর জোর বাড়তে চলেছে। চিহ্নিত অবৈধ অভিবাসীদের দেশ থেকে দ্রুত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আছে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মাটিতে গোপন তথ্য-সংগ্রহের কাজ। ফরাসি সরকার মনে করছে, এ এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। সুতরাং, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় চালাতে হবে আরও সামরিক অভিযান, এবং সামরিক খাতে বরাদ্দ করতে হবে বিপুল অঙ্কের অর্থ। তবে এত কিছুর পরও, ফরাসি জনজীবন কতটা সুরক্ষিত থাকবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষত জঙ্গি ইসলামের আঁতুড়ঘর, যেখান থেকে এই ভাবাদর্শের রূপায়ণ ও প্রচারখাতে প্রচুর অর্থ সাহায্য আসে, সেই সৌদি আরব ও কাতারের প্রতি ফ্রান্সের নরম নীতি বিস্ময় উদ্রেক করে।
ভুললে চলবে না, ফ্রান্সের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ (৭%) মুসলিম। ঔপনিবেশিক কারণে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমনিতেই একটা চাপা ক্ষোভ ও বঞ্চনা-বোধ আছে। স্বভাবতই রাষ্ট্রের সঙ্গে এদের সম্পর্ক বেশ জটিল। জঙ্গি ইসলামের পক্ষে অতি উর্বর ফ্রান্সের জমি। সালাফিতন্ত্র তো ঠিক ইসলাম ভাবাদর্শ নয়, বরং আত্ম-পরিচিতির সঙ্কটকে অবলম্বন করে এক ধর্মীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ। বর্তমান সঙ্কট থেকে মুক্ত হতে গেলে মুসলিম সমাজের সদস্যদের সমাজের সামনের সারিতে জায়গা পেতে হবে। তা কিছুটা হচ্ছেও। রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের একটা বড় অংশে অভিবাসী মুসলমানদের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জঙ্গি ইসলামকে প্রতিহত করতে, দীর্ঘমেয়াদে, এলিট বুদ্ধিজীবী মুসলমানদের দায়িত্ব ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে, স্বল্পমেয়াদে, সরকারের আর একটি পরিকল্পনা আছে। যে সব পল্লি জঙ্গি ইসলামের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে, সেখানে প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রবেশ ঘটানো। ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার বিপরীতে গণতান্ত্রিক উদারবাদকে তুলে ধরা। বলা যত সহজ, করাও কি তাই? সময়ই বলে দেবে।