নিজের ছবি পর্ন সাইটে ঘুরছে জেনে পুলিশের দ্বারস্থ হন দিশাহারা তরুণী। জানা যায়, বছরখানেক আগে তোলা তাঁর একটি নিজস্বী বিকৃত করে ওই ছবি তৈরি হয়েছিল। তাঁর মতো অনেক মহিলার ছবিই বিকৃত করে ছাড়া হয়েছিল। গত বছর সিঙ্গাপুরের ঘটনা এটা।
গত বছর জুলাইতে একই অভিযোগে পুলিশের দ্বারস্থ হন হায়দরাবাদের এক তরুণী। তাঁর পিছু ধাওয়া করে গোপনে ছবি তুলেছিল অভিযুক্ত। সেই ছবিই বিকৃত করে সে ছেড়ে দেয় একটি সাইটে।
দু’টি ঘটনারই যোগসূত্র এক। তা হল, ডিপন্যুড নামে একটি অ্যাপ ব্যবহার করেই ছবিগুলি বিকৃত করা হয়েছিল। অ্যাপটি গত বছর এপ্রিলে বাজারে এনেছিল ইউরোপের দেশ এস্টোনিয়ার এক সংস্থা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চলা এই অ্যাপের মাধ্যমে যে কোনও মানুষের সাধারণ ছবিকে বিবস্ত্র ছবিতে পরিণত করা যেত। মাস দুয়েকের মধ্যেই বিশ্ব জুড়ে এই অ্যাপের অপব্যবহার শুরু হওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। নিছক ‘মজার’ জন্য এই অ্যাপ তৈরি করলেও তা যে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে, তা মেনে নেয় সংস্থাটি। গত বছর জুনে বিবৃতি দিয়ে অ্যাপ তুলে নেয় নির্মাতা সংস্থা। তারা দায় সারলেও আন্তর্জালের এই সীমাহীন দুনিয়া থেকে যে ওই প্রযুক্তি চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব নয়, সেই আশঙ্কা ছিলই।
উদ্বেগটা যে মিথ্যে নয়, তার প্রমাণও মিলেছে তার পরে বেশ কয়েক বার। সম্প্রতি এ দেশেও সেই আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়েছে। মুম্বই পুলিশের নজরে এসেছে, সাইবার দুনিয়ায় ফের ফিরে এসেছে ডিপন্যুড। একাধিক সাইটে, এমনকি টুইটারেও মিলছে ডিপন্যুড প্রযুক্তি। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র পুলিশের সাইবার অপরাধ শাখার সুপারিন্টেন্ডেন্ট বলসিং রাজপুত সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, তাঁরা এ বিষয়ে নজরদারি করতে ও কড়া পদক্ষেপ করতে একটি দলও গঠন করেছেন।
এখনকার পরিস্থিতি এমন অ্যাপের বিপজ্জনক প্রকৃতিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোভিড ঠেকাতে ঘরবন্দি দশায় সাইবার দুনিয়ায়, বিশেষত সমাজমাধ্যমে আমজনতার বিচরণ বেড়েছে অনেকটাই। সমীক্ষা বলছে, লকডাউন শুরুর আগের সপ্তাহ থেকে লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে সমাজমাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। লকডাউনের আগে এক জন প্রতি দিন সমাজমাধ্যমে সময় কাটাতেন গড়পড়তা ১৫০ মিনিট। লকডাউনের প্রথম সপ্তাহেই তা বেড়ে হয় ২৮০ মিনিট। সমীক্ষা বলছে, লকডাউন শুরুর আগের থেকে এখন ৭৫ শতাংশ বেশি মানুষ ফেসবুক, টুইটার ও হোয়াটসঅ্যাপে সময় কাটাচ্ছেন।
এই সময় কাটানোর একটা বড় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে সমাজমাধ্যমের গণ-পরিসরে ব্যক্তিগত ছবি দেওয়া। সেই ছবি যে দুষ্কৃতীরা হাতিয়ে তা বিকৃত করে ব্ল্যাকমেলিংয়ের জন্য ব্যবহার করবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই। হালে নানা অ্যাপের মাধ্যমে নিজের ছবিকে রং-তুলিতে আঁকা চিত্রকলার ধাঁচে গড়ে তোলা, বা নিজের বৃদ্ধাবস্থার কাল্পনিক অবয়ব দেখার হিড়িক দেখা যাচ্ছে। এমন সব অ্যাপই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কাজ করে। আর তা করতে গেলে ওই অ্যাপগুলিকে মোবাইলের গ্যালারিতে, মানে নিজের ব্যক্তিগত ছবি রাখার ভান্ডারে, প্রবেশাধিকার দিতে হয়। সেখানেও বিপদের আশঙ্কা।
পরিসংখ্যানও এই আশঙ্কায় সায় দিচ্ছে। জাতীয় মহিলা কমিশন এপ্রিলে ৫৪টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে। মার্চে সেই সংখ্যা ছিল ৩৭ এবং ফেব্রুয়ারিতে ২১। সরকারি পরিসংখ্যানের বাইরে সংখ্যাটা অনেক বেশি। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা একাধিক সংস্থার দাবি, ২৫ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে তারা ৪১২টি অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৩৯৬টি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যেগুলির ক্ষেত্রে আক্রান্তরা সকলেই মহিলা। রয়েছে হ্যাকিংয়ের হুমকি, ব্যক্তিগত ছবি ফাঁসের ভয় দেখানো, ছবি বিকৃতি, ব্ল্যাকমেলিংয়ের মতো অভিযোগ। এগুলিকে অপরাধের পরিভাষায় ‘সেক্সটর্সন’ বলা যায়। ভয় দেখিয়ে টাকাও চাওয়া হচ্ছে। লকডাউনের আগে এমন অভিযোগ দিনে ১০-১২টি এলেও এখন তা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে।
সাইবার-দুষ্কৃতীরা ফাঁদ পাতার জন্য বেছে নিয়েছে এমন একটা সময়কে, যখন তারা নিশ্চিত, মানুষের সাইবার-গতিবিধি বাড়বেই। ঘরবন্দি বিশ্বে সাইবার দুনিয়াতে এখন চলছে হরেক প্রলোভন! একটি ডেটিং অ্যাপ এক দেশে বসে অন্য মহাদেশের কারও সঙ্গে চ্যাট করার সুযোগ দিচ্ছে। এমন চ্যাটে অপরাধীরা যে ফাঁদ পাতে, তার নজির রয়েছে একাধিক। ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি হাতিয়ে তা প্রচার করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেলিংয়ের অভিযোগ উঠেছে আগে বহু বার। এখন ছবির অপব্যবহারের আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
অপরাধীরা আসলে সুযোগ নিচ্ছে। তারা সুযোগ নিচ্ছে মানব-প্রবৃত্তির। তারা জানে, ঘরবন্দি থাকলে বাধ্য হয়েই সাইবার দুনিয়ায় ঢুকে পড়বেন অনেকে। এর সমাধান রয়েছে আমাদের হাতেই। আমরা যদি প্রযুক্তির হাতে, প্রবৃত্তির হাতে বাধ্য না হই, তা হলে অপরাধীদেরও কৌশল অনেকটা ভোঁতা হয়ে যাবে। আমরা যদি সমাজমাধ্যমে ব্যক্তিগত ছবি না দিই, সমাজমাধ্যমের ব্যবহার কমিয়ে বই পড়া, গান শোনা বা অন্য কোনও কাজে সময় দিই, তা হলে এমন ঝুঁকিও কমে যায় অনেকটা।
গত বছর ২৭ জুন ডিপন্যুড তুলে নিচ্ছে বলে টুইটারে বিবৃতি দেয় নির্মাতা সংস্থা। তারা বলেছিল, বিশ্ব এখনও ডিপন্যুডের জন্য তৈরি নয়। তার পর এক বছর কেটেছে। আমরা বিশ্বকে কী ভাবে তৈরি করব সেই সিদ্ধান্ত আমাদের হাতেই।