Delhi Violence

ঘরের পাশে আগুন, ভয় করছে

ঘৃণার সুপরিকল্পিত রাজনীতিতে কতটা পাক ধরলে, তা আপনার আমার বাড়ির একেবারে দোরগোড়ায় এসে পৌঁছয়?

Advertisement

শ্রীদীপ

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:২৮
Share:

ভয়ের ছবি দিল্লিতে।

ঘৃণার সুপরিকল্পিত রাজনীতিতে কতটা পাক ধরলে, তা আপনার আমার বাড়ির একেবারে দোরগোড়ায় এসে পৌঁছয়? যদিও তখনও গণমাধ্যম দ্বারা প্রশিক্ষিত মন মজে থাকে ১০০ কোটি টাকার ট্রাম্পলীলা ও তার ঝকঝকে প্রদর্শনে। আর ঠিক একই সময় রাজধানীর দশটি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়।

Advertisement

দিল্লির যে প্রান্ত জ্বলছে, তার থেকে আমার বাড়ি নিরাপদ দূরত্বে। কর্মক্ষেত্রে এখনও নিশ্চিন্তে যাওয়া যায়— জানি, সেখানে কেউ লোহার রড, পেট্রলের বোতল বা পিস্তল হাতে অপেক্ষা করে নেই। কিন্তু, এটাও জানি, দূরত্বের এই অলীক নিরাপত্তা উধাও হয়ে যেতে সময় লাগবে না ক্ষণেকও। যে কোনও মুহূর্তে আমি, আমরা, আমার মতো ‘এলিট নাগরিক’-এরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা বিপন্ন মুখ হয়ে উঠব। ভয় করছে খুব। ঘৃণার অস্ত্রকে একেবারে সামনাসামনি দেখার ভয়।

বিদ্বেষের আগুনে আরও কতটা জ্বালানি ঢাললে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে আরও অনায়াসে লেলিয়ে দেওয়া যাবে? জনগণ ভুলে থাকবে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও উন্নয়নের বেহাল? বিবিধতা ও ভিন্নতার স্বীকৃতি হয়ে উঠবে কাল্পনিক ও ব্রাত্য ভাবনা? যুক্তি-তর্ক-দৃশ্য-প্রমাণকে ছাপিয়ে স্থাপিত হবে অগাধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে জড়ো হওয়া ভিড়, যারা ওত পেতে থাকবে— অসম্মতির চিহ্ন দেখলেই তা দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য?

Advertisement

বিভাজনের প্রবৃত্তি কী পরিমাণ দানা বাঁধলে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও প্রয়োগ করেও বারবার পার পাওয়া যায়? মেরুকরণের রাজনীতি কতটা গভীরে শিকড় ছড়ালে পুলিশ কখনও পাঠাগারে ঘুরে ছাত্র পেটায়, কখনও নীরবে দূরে দাঁড়িয়ে উদ্ধত বর্বর বাহিনীর তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করে? কখনও পর্যাপ্ত পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয় না, হিংস্র কিছু মানুষকে লাগামছাড়া ভাবে লেলিয়ে দেওয়া হয়।

গত কয়েক মাসে এ সবই এখন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে। সেই স্বাভাবিকতা দেখে ভয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে।

বিদ্বেষের বিষ যত ছড়িয়েছে, তত সহজ হয়েছে ‘শত্রুপক্ষ’ খুঁজে নেওয়া— সংখ্যালঘু, ছাত্রসমাজ, ভিন্নমত-পোষণকারী বা বুদ্ধিজীবী। দৈনন্দিন জীবনে হিংসার এই স্বাভাবিকীকরণ স্বাধীন ভারতে অভূতপূর্ব। রাজধানীর মতো শহরেও যখন তখন চাগাড় দিতে পারে হিংস্রতা— পাশের পাড়ায়, নিকটবর্তী গলিতে বা কাছের মহল্লায়।

প্রসঙ্গ বা প্রশ্ন এটা নয় আপনি কার বা কিসের সমর্থক। বা আপনার কী চাই— এনআরসি, না আজাদি। দেশব্যাপী জনতাকে একে অপরের বিরুদ্ধে সংগঠিত ভাবে ব্যাপক আকারে খেপিয়ে তোলা গিয়েছে ধর্মের নামে, সত্তাপরিচিতির নামে। তাই তো পোশাক দেখেই চেনা যাচ্ছে ওঁরা কে বা ওঁরা কারা হতে পারেন। তাই তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে অবলীলায় ঝরেছে জনতাকে তাতাবার বিদ্বেষবাণী— “গোলি মারো শালোঁ কো।” আদেশ মেনে আকছার এলোপাথাড়ি গুলিও চলছে, যেন সেটা খুবই তুচ্ছ, স্বাভাবিক ব্যাপার।

কোথা থেকে উদ্ভব হচ্ছে এত বিদ্বেষের? লাঠি পাথর বন্দুক তুলে নেওয়ার বৈধতা তাঁরাই জোগাচ্ছেন, যাঁরা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে ‘অপর সম্প্রদায়ের মানুষ’ বলে সাব্যস্ত করার জন্য অহরহ খেটে চলেছেন। জনসমক্ষে নির্দ্বিধায় বলছেন, দেশভাগের সময় সেই ‘অপর সম্প্রদায়ের মানুষ’গুলো ওপারে চলে গেলেই ল্যাঠা চুকে যেত। কখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা বলছেন আতঙ্কবাদী, আবার কখনও শাহিন বাগের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের সম্ভাব্য ধর্ষক বলে ঘোষণা করে দিচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে বলছেন, শাহিন বাগের প্রতিবাদীদের ইলেকট্রিক শক দিতে। বহে নিরন্তর অনন্ত ঘৃণার প্রবাহ। ঘৃণাই এর সম্বল ও মূলধন। ভাষায়, চলনে, বলনে এ রাজনীতি বিদ্বেষগামী। তা উৎসাহিত করে নির্ধারিত ও চিহ্নিত ‘অপর’-এর উপর পরিকল্পিত প্রহার হানতে। তা মান্যতা দেয় অযথা দ্বন্দ্বকে। তা প্রাধান্য ও প্রশ্রয় দেয় হিংসাকে, হিংসার স্বাভাবিকীকরণ ও দৈনন্দিনীকরণকে।

রাষ্ট্রযন্ত্র আর বাহুবলের সমান ব্যবহারে ঘৃণার যে বন্দুক চলছে, তার নিশানায় আমরা সবাই আছি। না থেকে নিস্তার নেই, কারণ ঘৃণার রাজনীতিকে তার ‘শত্রু’ খুঁজে নিতে হবেই। সেই শত্রুর নিধনকামনাই হবে রাজনীতির চালিকাশক্তি। কথাটা চিরকালই সত্যি, কিন্তু সুতীব্র ভয়টা আজকের মতো এত সত্যি কখনও হয়নি। চার দিকে তাকিয়ে দেখছি, একটাও আশ্রয় নেই, একটাও ঠিকানা নেই, বিপন্ন হলে যার কাছে ঠাঁই পেতে পারি। এখন এই হিংসা সত্য, আর সত্য আমাদের আনখশির ভয়।

রাষ্ট্রবাদের নামে বিদ্বেষের যে বীজ বপন করা হয়েছে, এবং যে বিষ গেলানো হয়েছে প্রতিনিয়ত— এ হিংসা তারই পরিণাম। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, উদারমনস্কতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এখন অলীক ঠেকে। এখন শুধু শত্রুবাছাই চলবে। পোশাক দেখে যদি চেনা না যায়, প্রয়োজনে পোশাক খুলে লিঙ্গ উন্মোচন করার আদেশ দিয়ে নির্ণয় করা হবে আপনার পরিচয়। প্রাণের ভয়ে আমরা বাধ্য হব আত্মসম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে নিজের ধর্মপরিচিতি খুলে দেখাতে। এর পরও ভয় করবে না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement