তেলেভাজার সুদিন কি অস্তমিত? ছবি: সংগৃহীত।
গাঁ গাঁ করে জ্বলছে উনুন। উপরে বসানো কড়াইয়ে টগবগ করে ফুঠে ঘনকৃষ্ণবর্ণ তেল, আর তাতে অতি দক্ষ হাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে একটির পর একটি। ক্রমে ফুলে উঠছে তারা। এক দিক ফুলে উঠলেই নিক্ষেপকারী হাতটিই একটি কাঠি দিয়ে উলটে দিচ্ছে সেটিকে। তার পর তাতে বাদামি রং ধরছে। কড়াইয়ের ভিতরে অমানিশাপ্রতিম অন্ধকারের বুকে গ্রহপুঞ্জের মতো উথালপাথাল হচ্ছে এক ঝাঁক গোলাকৃতি বস্তু।
উপরের বর্ণনা পড়ে কেউ যদি এটিকে কোনও কল্পবিজ্ঞান সিনেমার দৃশ্য বা কুম্ভীপাক নরকের বিবরণ বলে ধরে নেন, তিনি ভুল করবেন। এটি আসলে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে বহু কাল ধরে চলে আসা সান্ধ্য তেলেভাজার দোকানে আলুর চপ ভাজার দৃশ্যরূপ। এখন, কেউ যদি এর মধ্যে ভূমাদর্শন করতে চান, তবে তাঁকে বাধা দিচ্ছে কে? এমনিতেই বাঙালির অন্তঃস্তলে একটা সুপ্ত বৈরাগ্য হিলিবিলি খেলে যায়। তার উপর ঝিম ধরা সাঁঝে আলুর চপ আর মুড়ির যুগলবন্দি তাকে আরও খোলতাই করে তোলে। আলুর চপের জায়গায় বেগুনি, ফুলুরি থাকলেও ক্ষতি নেই। সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি নাগরিক/ উপনাগরিক/ গ্রামীণ— সব রকম পরিমণ্ডলেই সেই উদাসীনতা একই স্বাদের। এক খাবলা মুড়ি আর তেলেভাজায় একটা ছোট কামড় যেমন ভুলিয়ে দিতে পারে শ্রমজীবী জীবনের ক্লান্তি, তেমনই তা প্রলেপ দিতে পারে কোচিংপথগামিনী কিশোরীর দৃষ্টিপ্রসাদ থেকে বঞ্চিত রোয়াকজীবনে অথবা উস্কে দিতে পারে পার্টি অফিসে লেনিনের ছবির নীচে বসে যৌথ খামারের স্বপ্ন নিয়ে আলোচনারত যুবাকুলকে। ‘শুধু কেরানি’ জীবনে করুণাধারায় নেমে আসা অফিস-ফেরতা চায়ের সঙ্গে টা, বাড়ির বৌ-মহলের গজলসায়, জিভে উস্ উস্ শব্দে ঝালতরঙ্গ প্রকাশ করা সদ্যযুবতীদের গোপনকথায় তেলেভাজা যেন অণুঘটক। কার্যত বঙ্গজীবন আর তেলেভাজা— এই দুইয়ের ওতপ্রোত সংযোগ নিয়ে লিখতে বসলে রাত কাবার হয়ে গিয়ে পরের দিনের উনুন ধরানোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
হাতিবাগানের লক্ষ্মীনারায়ণের পরিচিতি ‘নেতাজি’র তেলেভাজা নামেই। ছবি: সংগৃহীত।
কিন্তু বঙ্গসমাজ ইদানীং আর ঠিক তেমনটি নেই। ইউটিউব ভিডিয়ো থেকে সমাজমাধ্যমে লম্বা লম্বা পোস্ট জুড়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কে ইয়াব্বড় সব পরামর্শ। সে সবের সারকথা একটাই— ক্যালোরি পোড়াও। অতএব ডুবো তেলে ভাজা খাবার ছাড়ো, জিমে যাও, নিদেন পক্ষে যতক্ষণ না পর্যন্ত জিভ বেরিয়ে আসছে পাড়ার পার্কে ওয়াকিং শ্যু পরে কদম কদম বাড়িয়ে যাও। এ সব কথায় কর্ণপাত না করেও উপায় নেই। নন্তুমামার শালার জোয়ান ছেলে অফিস থেকে বেরিয়েই হার্ট অ্যাটাক, পান্তুপিসির দেওরের সিওপিডি… এ সব খবর কানে ঢুকে চলেছে অনর্গল। ফলে রোব্বারে ডালডানুচি বন্ধ, টিফিনে স্ট্রিট চাউমিন ওয়াকওভার, রাতে হোলগ্রেন আটার দু’খানি ভুষোরুটি আর রাজ্যের পাতাপুতা দিয়ে স্যালাড, ঘুম ভাঙলেই চিয়া চিয়া করে কানের কাছে গিন্নির ফুসুর ফুসুর। এমতাবস্থায় তেলেভাজা? তা-ও আবার মোড়ের দোকানের? নৈব নৈব চ। একান্ত জিভ সুড়সুড় করলে মাসে এক দিন ‘চিট ডে’। আলুর টিকিয়ায় সিলিকনের বুরুশ দিয়ে জলপাইয়ের তেল মাখিয়ে এয়ার ফ্রায়ারে বন্দোবস্ত। কিন্তু এতে কি মন মানে? রগুবীর কি রক্কে করেন বাঙালির বাপ-পিতেমোর সমোসকিতিকে? সে দিক থেকে দেখলে, ‘বঙ্গীয় চপ শিল্প’ কি এই মুহূর্তে সঙ্কটের সামনে?
এ হেন স্বাস্থ্য সচেতনতার সমান্তরালে কিন্তু আর এক কাণ্ড অহরহ ঘটেই চলেছে। তা হল অপেক্ষাকৃত নতুন কিছু খাবারে রসনাকে সঁপে দেওয়ার ব্যাপার। পিৎজ়া, পাস্তা, বার্গারে বঙ্গজন খুব বেশি দিন অভ্যস্ত হননি। সান্ধ্য আহারের ঠেকগুলি এই মুহূর্তে চেহারা বদলে ‘ক্যাফে’। দক্ষিণ কলকাতার এক বিশেষ পল্লিতে ঘরে ঘরে ক্যাফে আর তাতে দিনভর ইংলিশ ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। পাশাপাশি আবার চিজ়-টুপটুপ পিৎজ়া অথবা যথযথ ড্রেসিং-সহ স্যালাডের উপস্থিতিও বেশ দমদার। সেখানে তেলেভাজা? বিধাতাপুরুষ কাক্কেশ্বর কুচকুচের কায়দায় ঘাড় নেড়ে নেতি জানাবেন। ও দিকে আপনি ক্যালোরিমাত্রা না জেনেই গলাধঃকরণ করে ফেলেছেন সালামি সমেত স্যান্ডউইচ অথবা পর্ক সসেজ। ক্যাফে থেকে খানিক হেঁটে যেতেই নাকে এসে ঢুকল ঝুপড়ির মধ্যে টিমিটিমে বাল্বের আলোর নীচে জ্বলন্ত কড়াইয়ে অন্ধকার তেলসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকা বেগুনি বা আলুর চপের গন্ধ। মন উড়ু উড়ু হলেও পায়ে শিকলি। বিধাতাপুরুষ দাঁড়কাক সেজে মাথার উপর চক্কর কাটছেন আর ক্রমাগত সাবধান করে চলেছেন।
আমিষ তেলেভাজার ঐতিহ্য কালিকা-য় আজও অমলিন। ছবি: সংগৃহীত।
এই সব আবহে কি আদৌ ভাল আছে বাংলার তেলেভাজা? না কি সে তার সমাদর ভুলে, কৌলীন্য হারিয়ে এখন নেহাতই ‘সাবঅল্টার্ন’ খাদ্য? বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে পরিজন ভেদে খাবার পরিবেশিত হত একদা। দূরের কেউ এলে ইঙ্গ-বঙ্গ চপ-কাটলেট, সন্দেশ-রসগোল্লা। কুটুম বা কনে দেখা পারপাসে শিঙাড়া অবধারিত। আর নেহাতই আত্মজন, একেবারে কাঁধে হাত রাখা ইয়ারবন্ধু এলে মুড়িমাখা, আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুড়ি। সেই দিন যে আজ আর নেই, তা বলে দিতে হবে না। দুধে টইটম্বুর, চিনিতে চুবুচুবু চা আজ বঙ্গজীবনে ব্রাত্য। মধুবনী সুসজ্জিত বসার ঘরে বাঙালির কাপে ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ, গ্রিন টি। অনুপানে ওট্স-মেশানো বিস্কুট, নয়তো পেস্ট্রি, পিৎজ়া। ক্যালোরি কি কম পড়ছে তাতে? খোদায় মালুম। কিন্তু, মধুবনী-আবহ থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশের দোকান থেকে একপিস চপ নিয়ে দুধ চা খাওয়ার বিলাসও কি আজ টিকে আছে? বাঙালির খাদ্যাখাদ্যবিনিশ্চয় আজ কি খাড়াখাড়ি দুটো বর্গে বিভাজিত? তেলেভাজা কি নিম্নবর্গের খাবারের তকমা নিয়ে ক্রমেই অবলোপের পথে?
এই সব উনিশ-বিশ মনের মধ্যে পাক খেলে যদি সমাজমাধ্যম খুলে বাঙালির ‘ফুডব্লগ’ দেখতে থাকেন, তবে টের পাবেন, ঘটনা ঘোরঘট্ট। ইউটিউব থেকে ফেসবুক— আপলোড হওয়া কন্টেন্টের অধিকাংশ জুড়েই রয়েছে তথাকথিত ‘নিম্নবর্গের খানা’। কলকাতার অলিগলির কোথায় আজও কোন তেলেভাজার দোকানে ‘লড়াইয়ের চপ’ বিক্রি হয়, নিরামিষ তেলেভাজায় কে এগিয়ে— বাগবাজারের পটলা, না কি হাতিবাগানের লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ… এই সব নিয়ে নিয়মিত চপানউতর। কলকাতাকে টেক্কা দিতে মফস্সলও হাতে তুলে নিয়েছে স্মার্টফোন। বৌদির বিরিয়ানি থেকে নেত্যদার পেটাই পরোটা সেখানে মুখ দেখাচ্ছে। পাশাপাশি, দূর শহরের তেলেভাজা নিয়েও তরজা জমজমাট। রানাঘাটের সঙ্গে কৃষ্ণনগরের, বোলপুরের সঙ্গে পুরুলিয়ার, কোচবিহারের সঙ্গে নিমতিঝোরার চপ শিল্পের সংঘাতে পলাশির প্রান্তরে যেন কোম্পানি নিশান কেঁপে উঠছে। তখন কোথায় ক্যালোরি আর কোথায় কার্ডিয়ো! সারা বাংলাই যেন সুবিশাল কড়াইয়ে ফুটছে। তবে লক্ষ করার ব্যাপার, এই সব ফুড ব্লগ যাঁরা লিখছেন, বা ভিডিয়ো তুলে আপলোড করছেন, তাঁদের আধিকাংশই প্রমিত বাংলা ভাষা থেকে খানিক দূরে বাস করেন। আসলে এই সব ব্লগ, ভ্লগ একান্তই হৃদয়ের উৎসস্রোত থেকে উঠে আসা। সেখানে জিম নেই, ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শ নেই। একটু ভেবে দেখলে মনে হতেই পারে, জীবন-মরণের তোয়াক্কাই যেন নেই সেখানে। তা হলে তেলেভাজা কি নাগরিক বৃত্ত থেকে উপনাগরিকতার দকে হাঁটা দিল?
এমন বিবিধ প্রশ্ন জাগলে ভেবে দেখা যেতেই পারে খোদ শহর কলকাতার বুকে বেশ কিছু তেলেভাজা বিপণি আজও রমরম করে চলছে। হাতিবাগানের লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের দোকান (যেটিকে ‘নেতাজির তেলেভাজা’ বলেও অনেকে জানেন, দোকানের মাথায় সুভাষচন্দ্রের ছবির কারণে)-এর কর্ণধার কেষ্টকুমার গুপ্ত (সাউ) কিন্তু একেবারেই মানতে রাজি নন, তেলেভাজার চাহিদা কমেছে বা তার মহিমা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ১৯১৮ সালে কেষ্টবাবুর ঠাকুরদা এ দোকান বানিয়েছিলেন। পরে বাবা লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের আমলে দোকানের নামকরণ ও সমৃদ্ধি। এখন কেষ্টবাবুর ছেলে ও নাতিরাও ব্যবসার কাজে হাত লাগান। সব মিলিয়ে পাঁচটি প্রজন্ম তেলেভাজা বানিয়ে চলেছে, ব্যাপারখানা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়! কেষ্টবাবু বললেন, “চাহিদা তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন আইটেম যোগ হয়েছে।” চিরন্তন আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুরির সঙ্গ দিচ্ছে পনির কাটলেট, পনিরের চপ, মাশরুম চপ, আমের চপ, নারকেলের চপ, সয়াবিনের চপ এবং সয়াবিনের কিমা কাটলেট। দোকানের এক পাশে ভুজিয়ার সম্ভার। এ-ও কি নতুন সংযোজন? কেষ্টবাবু জানালেন, একেবারেই না। ১৯৭০ সাল থেকেই তেলেভাজার সঙ্গত করছে ঝুরিভাজা, কাঠিভাজার মতো ভুজিয়া। তরুণ প্রজন্ম রোল, চাউমিন, বিরিয়ানি, পিৎজ়া খেলে কেষ্টবাবুর আপত্তি নেই। তাঁর কথায়, “বিরিয়ানি বিরিয়ানির জায়গায়, তেলেভাজা তেলেভাজার।” হক কথা, সন্দেহ নেই। যে ছেলেটি সপ্তাহান্তে থিনক্রাস্ট পিৎজ়ার সন্ধান করে, সে সপ্তাহের অন্য দিনে খেতেই পারে পনিরের কাটলেট, নারকেলের চপ। কেষ্টবাবু জানালেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে আম আর সয়াবিনের চপ ‘সুপারহিট’।
বাগবাজারুরা পটলার তেলেভাজার ব্যাপারে পরিবর্তিত সময়েও আপস করতে নারাজ। ছবি: সংগৃহীত।
তবে তেলেভাজা দুনিয়ার একটা অন্য পিঠও রয়েছে। সেই ‘ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন’-এর নাম আমিষ তেলেভাজা। কলকাতার আমিষ তেলেভাজা জগতে সূর্য সেন স্ট্রিট তথা মির্জাপুরের ‘কালিকা’ এক জবরদস্ত জয়েন্ট। ১৯৩৫ সালে পথচলা শুরু এ দোকানের আজও যে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি, তা খানিক গর্বের সঙ্গেই জানালেন কর্ণধার বাবলু দত্ত। দোকান যখন শুরু হয়, তখন নিরামিষ তেলেভাজাই তৈরি হত। আলুর চপ, বেগুনি অবশ্যই হত। পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় চিংড়ি, পাঁঠার মাংস, মাছের চপের মতো আমিষ পদ। বাবলুবাবু জানালেন, পুরনো কারিগর দেহ রাখার পর নিরামিষ তেলেভাজা তৈরির কারিগর পাচ্ছিলেন না। আবার যেমন-তেমন করে চালিয়ে যাওয়ারও তিনি পক্ষপাতী নন। “কোয়ালিটির সঙ্গে কোনও কম্প্রোমাইজ় নয়। নিরামিষের উপযুক্ত কারিগর না মেলায় ২০০০ সাল থেকে আলুর চপ, বেগুনি তুলেই দিলাম। এখন মোচা আর ভেজিটেবিল চপ ছাড়া সবটাই আমিষ।” এই ২০০০ সালের ব্যাপারটা কেমন তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে না! মিলেনিয়াল প্রজন্ম কি হাত তুলে নিল নিরামিষ তেলেভাজা থেকে? বাবলুবাবুর উত্তর, “একেবারেই নয়। মোচা-ভেজিটেবিলেরও চাহিদা বিপুল।” সন্ধ্যায় বাইক থামিয়ে নব্যপ্রজন্ম ফিশফ্রাই, ফিশ রোলের পাশাপাশি মোচা-ভেজিটেবিলও চেখে দেখে। আর সন্ধ্যা ফুরোনোর আগেই কাচের বাক্সভর্তি তেলেভাজাও উধাও। রোজ ১০০ পিস ফিশফিঙ্গার, ৫০-৬০টা ফিশফ্রাই আর সমপরিমাণ রোল তৈরি করেন। কিছুই পড়ে থাকে না। ‘কালিকা’র মূলমন্ত্র একটাই— গুণমানের সঙ্গে কোনও আপস নয়। বাবলুবাবুর কথায়, “কমবয়সিরাই বেশি আসেন। দাঁড়িয়েই খান। তাঁদের মধ্যে যে জিমভাঁজা চেহারা চোখে পড়ে না, তেমনও নয়।”
তা হলে কি রসনার বাসনার সঙ্গে সহাবস্থানেই রয়েছেন স্বাস্থ্যভাবুক বঙ্গজন? তেলেভাজা নিয়ে যত উথালপাথালই হোক না কেন, তার মূল লীলাভূমি উত্তর কলকাতা। বিশেষত বাগবাজার। অলিগলি চলিরাম তেলেভাজা এখানে। পটলার দোকান আর বাগবাজার ব্যায়াম সমিতি কি সহাবস্থানে ছিল না ইতিহাসে? পটলার দোকানের সামনের গলি দিয়ে হেঁটে উপগলি ঠাকুর রাধাকান্ত লেন। এখানেই নিবাস ‘উত্তর কলকাতার কবিতা’-খ্যাত কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর সেই কাব্যগ্রন্থেও কয়েক বার উঁকি দিয়ে গিয়েছে তেলেভাজার প্রসঙ্গ। দাপুটে মেজবাবু, যিনি দাঙ্গার সময়ে গুন্ডাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ‘মোছনমানদের’ বাঁচিয়েছিলেন, তিনিও শেষ বয়সে লুকিয়ে তেলেভাজা আর অ্যান্টাসিড খেতেন— এ দৃশ্য জ্বলজ্বল করছে প্রসূনবাবুর কবিতায়। তেলেভাজার প্রসঙ্গ উঠতেই হাঁ- হাঁ করে উঠলেন ১৯৫৬-এর জাতক। “বংশ পরম্পরায় বাগবাজারুরা পটলা খেয়েছে, তার আশপাশের দোকানের তেলেভাজাও খেয়েছে। আর আমি আজও চালিয়ে যাচ্ছি।” এই সব সাতপাঁচ… স্বাস্থ্যচিন্তা… “ধুস্। কোলেস্টেরলের কথা ভাবলে চলবে কেন? তবে এখান মাত্রা কমেছে। রোজ খাই না। খেলেও দুটোর বেশি খাই না,” প্রসূনবাবুর চোখে সামান্য ঔদাসীন্য।
বাগবাজারে পটলার দোকানের সামনে আজ পথ-কবাবের সমারোহ। সে কবাব কিন্তু পটলার সান্ধ্য রাধাবল্লভিকে দমাতে পারেনি। পারেনি তার বিবিধ চপকেও দমাতে। সাউ বা ‘কালিকা’য় বহু বার স্বাদগ্রহণ করলেও কবি যে পটলাতেই আত্মস্থ, তা জানাতে দ্বিধা করলেন না। জানাতে ভুললেন না, এ স্বাদ সক্কলের চাইতে আলাদা।
তা হলে কি কলকাতার খাদ্যপথে পিৎজ়া, বার্গারের উড়ালপুল আর তেলেভাজার অলিগলি সহাবস্থানেই? ভেবে দেখলে তেমনই মনে হয়। তবে ওই যে, কানের কাছে মাঝেমধ্যেই স্বাস্থ্যঘড়ি পিড়িং পিড়িং করে অ্যালার্ম বাজায়। উড়ালপুল পার হতে হতে চোখে পড়ে যায় হাসপাতালের বিজ্ঞাপনে হার্ট অ্যাটাকের ছবি। সমাজমাধ্যম আর সংবাদমাধ্যমের জীবনধারার পাতা জানান দেয়— জল বাড়ছে। বেড়ে চলেছে রক্তে ভাসমান চর্বিকণিকা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে। শহরের বিমর্ষ শূন্যতামাখা রাত। ‘লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ’-এর দোকানে তখন শৌখিন পনির কাটলেট আর সয়াবিনের কিমার চপের পালা শেষ। পিতলের বিশাল থালিতে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে সনাতনী আলুর চপ, বেগুনি। মুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে যাঁরা সে সবে কামড় দেবেন, তাঁরা শহরে ঘাম আর রক্ত বেচে দিন গুজরান করেন। তাঁদের যাপনে কোলেস্টেরল নেই, হৃদয়বেদনার দুর্ভাবনাও নেই। মধ্যবিত্তের চেনা জগতের দেড় আঙুল পাশ দিয়ে বয়ে যায় যে জীবন, তেলেভাজা সেখানে নিত্য বহে যাওয়া ধলেশ্বরীর মতো সত্য। দিনান্তের গ্লানি মুছিয়ে দিতে পরনে ঢাকাই শাড়ি আর কপালে সিঁদুর পরে যেন অপেক্ষা করে ডুবো তেলে ভাজা সেই সব ‘আদি পদ’। সময় থমকে রয়েছে সেখানে। সেখানে ঢুকে পড়তে চাইলেও পারা যায় না। মধ্যবিত্ত তার ফেরার নৌকো অনেক দিন আগেই পুড়িয়ে ফেলেছে।