নবজাগরণ-স্নাত ইউরোপে ‘ডিভিনিটি’ বা ধর্মশিক্ষার বিপরীতে উদ্ভব হইয়াছিল ‘হিউম্যানিটিজ়’ বা মানববিদ্যার। সেই যুগে যাহা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত ধ্রুপদী গ্রন্থসকলের চর্চায়, কালে কালে তাহাই বহুশাখ হইয়াছে। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, আইন, রাজনীতি হইতে শুরু করিয়া মানবসমাজ ও সংস্কৃতির সকল অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করিয়াছে বিদ্যাচর্চার এই ধারাটি। বিজ্ঞানের অনুশীলন যখন যুক্তি ও প্রমাণের আলোকে মানুষের অস্তিত্বকে নাড়াইয়া দিল, তখনও মানববিদ্যা তাহাকে আনন্দ দিয়াছে। আধুনিক যুগে তাহার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা মননের দিগন্তকে সুদূরপ্রসারী করিয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। আঘাতও অবশ্য কম আসে নাই। প্রান্তিকতাকে আশ্রয়, বহুস্বরকে প্রশ্রয় দেয় বলিয়া রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তাহার ডানা ছাঁটিতে, কণ্ঠরোধ করিতে চাহিয়াছে। তবু দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মানববিদ্যা বিভাগ হইয়া উঠিয়াছে নূতন ধারণাসকলের ঠিকানা, আন্দোলনের ধাত্রীভূমি। ঔদার্য ও যুক্তির অভাব ঘটিলে সমাজ তাহাদের দিকে সাগ্রহে তাকাইয়াছে, আঁধারে আলোক তো ওইখান হইতেই আসিবে।
বর্তমান ভারতের চিত্রটি এই প্রসঙ্গে বিশেষ লক্ষণীয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের মানবিক বিষয়গুলির পাঠ্যক্রম নির্ধারণ চলিতেছিল, এমন সময়ে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের তাণ্ডবে সে কাজ মাথায় উঠিল। সভার কাজ বন্ধ হইয়া গেল, এবং এই সুযোগে বিজেপির ছাত্র সংগঠনটির সদস্যেরা যে মতলবে আসিয়াছিল তাহাও পূর্ণ হইল। বিশেষত ইংরাজি ভাষা-সাহিত্য এবং ইতিহাসের পাঠ্যক্রম লইয়া ছিল তাহাদের বিক্ষোভ। গুজরাত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বিষয়ক একটি ছোটগল্পে দুইটি চরিত্রের মধ্য দিয়া প্রকারান্তরে আরএসএস-এর নিন্দা করা হইয়াছিল, অতএব উহা পড়ানো চলিবে না। সাহিত্য পড়িতে গিয়া জাতপাত বুঝিবার আয়োজন চলিবে না। বিকল্প যৌন প্রবণতাগুলি খুঁজিয়া-বুঝিয়া লওয়ার পাঠকে বিদায় দিতে হইবে। আধুনিক ইতিহাসের পাঠ্যক্রম হইতে নকশালবাড়িকে বাড়ি পাঠাইতে হইবে। শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইংরাজি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার পাঠ্যক্রম হইতে বিতর্কিত অংশ বাদ দিবার নির্দেশ দিয়াছে এবং সংশোধিত পাঠ্যক্রম জমাও পড়িয়াছে। যদিও পাঠ্যক্রম নির্ধারণের কাজ সম্পূর্ণত উপাচার্য ও শিক্ষকদের, একটি ছাত্র সংগঠনের জোরে তাহাতে কেবল অনধিকার প্রবেশই নহে, অভব্য হস্তক্ষেপও চলিল। কেন মানবিক বিদ্যাগুলির উপর বাছিয়া বাছিয়া তাহাদের আক্রমণ? কেননা, বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে নাক গলাইবার অসুবিধা আছে। দেবদেবীরা যদৃচ্ছা উড়িতে কি অবতরণ করিতে পারিতেন, সুতরাং তাঁহারা মাধ্যাকর্ষণ জয় করিয়াছিলেন— বলিয়া পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যায়বিশেষের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার জিগির উঠানো যায় না। যদিও বিজেপির শাসনামলে বিজ্ঞান কংগ্রেসের অনুষ্ঠানমঞ্চ হইতে পুরাণপ্রাচীন ভারতে বিমান উড়িবার মতো অলজ্জ ঘোষণার আস্ফালন হইয়াছে, তবু সন্দেহ চলে না যে সংস্কৃতির পাঠ যদি দিতেই হয়, তাহা বিজ্ঞানের পরিবর্তে কলা ও মানবিক বিদ্যার মাধ্যমেই দেওয়া ভাল। তাই ইতিহাস ও সাহিত্যের উপর আক্রমণ। পাঠ্যপুস্তক হইতে বিরুদ্ধ মতাদর্শের উপস্থিতি মুছিয়া দিয়া শাসকবান্ধব নব পঠনপাঠনের বাধ্যতা। ইহাই এই কালের মানববিদ্যার ভবিতব্য।
এ দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের এই বারের প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিটির খসড়ায় জ্বলজ্বল করিতেছে উচ্চ শিক্ষাকে ‘উদার’ চক্ষে দেখিবার পরামর্শ, স্নাতক স্তরে পাঠ্য বিষয় রূপে ‘লিবারাল আর্টস’ আরম্ভ করিবার সদিচ্ছা, আগামী পাঁচ বৎসরের মধ্যে দেশব্যাপী পাঁচটি ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব লিবারাল আর্টস’ খুলিয়া দিবার উদাত্ত নির্ঘোষ। কেহ ভাবিতে পারেন, ইহা নিতান্ত স্ববিরোধী! মানবিক বিদ্যার উপর জোর দেওয়া, আর মানবিক বিদ্যার পাঠ্যক্রমের উপর আক্রমণ— একসঙ্গে এই দুইটি চলে কী করিয়া? প্রশ্নকারীদের বুঝিতে হইবে, দুইয়ের মধ্যে মোটেই বিরোধিতা নাই, বরং সম্পূর্ণ সাযুজ্য আছে। আপাতত কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে যে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, মানবিক বিদ্যার মাধ্যমে তাহা শিখানো সহজ বলিয়াই মানবিক বিদ্যার উপর এতখানি জোর পড়িতেছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বিক্ষোভকারীদের সহিত দিল্লির শাসকদের মনোজাগতিক দূরত্ব মোটেই বেশি নহে। একবিংশ শতকের ভারতের শিক্ষাজগতে মানববিদ্যার নবপ্রবর্তনা হয়তো এই ভাবেই চিত্তকে উদার করিবার বদলে সঙ্কীর্ণ করিবার লক্ষ্যে অপব্যবহৃত হইবে।
যৎকিঞ্চিৎ
নিউজ়িল্যান্ড ও ইংল্যান্ডকে কেন যুগ্ম বিজয়ী ঘোষণা করা হল না, অনেকেই ধন্দে। উইম্বলডনেও, ফেডেরার-জকোভিচের লড়াইয়ে, দু’জনেই দু’সেট করে পাওয়ার পর যখন আবার ১২-১২ হল, কেন দুই খেলোয়াড়কেই যুগ্ম বিজয়ী বলা হবে না, কেন টাইব্রেক হতেই হবে, সে প্রশ্নও জরুরি। আসলে আমরা একটা মাত্র লোককেই শিখরে দেখতে চাই, তাতে নাচানাচির সুবিধে হয়। চরম জয়ও যে ভাগ করে নেওয়া যায়, তাতে গৌরব বাড়ে বই কমে না, সে শিক্ষা স্বার্থপর মানবসমাজ পায়নি।