ছবি সংগৃহীত
স ংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহিবে সরকার, তাহাতে বিরক্তির কারণ থাকিতে পারে, তবে নূতনত্ব কিছু নাই। নূতন এইটুকুই যে, সেই প্রচেষ্টাকে এ বার সরকারি নীতি করিল জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন। সম্প্রতি তিপ্পান্ন পাতার ‘মিডিয়া নীতি’ প্রকাশ করিয়াছে ওই রাজ্য। তাহাতে বলা হইয়াছে, কোন খবরটি ভ্রান্ত (ফেক নিউজ), কোনটি অনৈতিক, কোনটি দেশবিরোধী, তাহা সরকার স্থির করিবে। কেবল সংবাদের সত্যতাই নহে, সাংবাদিকের অতীত সম্পর্কেও অনুসন্ধান করিবে সরকার। সরকারি বিচারে উতরাইতে না পারিলে প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করিবে তথ্য ও জনসংযোগ দফতর। একবিংশ শতকের গণতান্ত্রিক ভারতে এই ভাবেই ফিরিয়া আসিল ঔপনিবেশিক শাসনের অতীত। সংবিধান বাকস্বাধীনতাকে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দিয়াছে। সংবাদের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার। জাতীয়তাবাদ অথবা দেশের নিরাপত্তার অজুহাতে সেই স্বাধীনতাকে খর্ব করিবার, তাহাকে নিয়ন্ত্রণ করিবার এই চেষ্টা যেমন ভ্রান্ত, তেমনই বিপজ্জনক। সরকারের কাজের নজরদারি করা, তাহার সাফল্যের বিচার করা সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। এখন সরকারই সংবাদমাধ্যমের বিচারক সাজিয়া বসিতে চায়। ইহার বিপদ কী হইতে পারে তাহা ইতিমধ্যেই কি স্পষ্ট হয় নাই? সরকারের সমালোচনা আজ সাংবাদিকের দেশদ্রোহিতা বলিয়া প্রতিপন্ন হয়। সরকারি ক্ষমতায় বলীয়ান রাজনৈতিক দলের নেতাদের দুর্নীতি ফাঁস করিলে মানহানির মামলা দায়ের করা হয়। সামরিক বাহিনী কিংবা পুলিশের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংবাদে দেখাইলে দেশের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।
সাংবাদিকের বিপন্নতা এত দূর বাড়িয়াছে যে, সম্প্রতি এক প্রবীণ সাংবাদিক সুপ্রিম কোর্টের নিকট একটি আবেদন করিয়াছেন। তাঁহার প্রার্থনা, কোন কোন ক্ষেত্রে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ধারায় মামলা হইতে পারে, তাহা বাঁধিয়া দিক সুপ্রিম কোর্ট। ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হইয়াছে। তাঁহার অপরাধ, পঠানকোট ও পুলওয়ামার আক্রমণ, এবং বালাকোটের সামরিক অভিযানকে ‘রাজনৈতিক’ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হইয়াছে, এমন অভিযোগ তিনি করিয়াছিলেন। হরিয়ানা সরকার সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে গ্রেফতার করিতে উদ্যত হইয়াছিল, সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তাহা স্থগিত হইয়াছে। কিন্তু দেশদ্রোহিতার অভিযোগের তদন্ত চলিতেছে।
আইনসম্মত ও আইন-বহির্ভূত, সকল উপায়ে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের আয়োজন চলিতেছে। গত পাঁচ বৎসরে (২০১৪-২০১৯) ভারতে অন্তত ৪০ জন সাংবাদিক খুন হইয়াছেন। গুরুতর ভাবে আক্রান্ত হইয়াছেন প্রায় দুইশত সাংবাদিক। গোটা বিশ্বেই সংবাদের স্বাধীনতা কমিতেছে, কিন্তু তাহার সূচকে ভারতের নিম্নগতি গত পাঁচ বৎসরে অপ্রতিহত। কাশ্মীরের মিডিয়া নীতি আরও কয়েক ধাপ পিছাইয়া দিবে ভারতকে, সন্দেহ নাই। গণতন্ত্র আজ এতই দুর্বল, যে সরকারি প্রকল্পের ত্রুটিবিচ্যুতি দেখাইলেও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হইতেছে। কাশ্মীরের মিডিয়া নীতি নাকি দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করিতে জরুরি। দমননীতি দিয়া নিরাপত্তা রক্ষা করা যায় কি?