বিপর্যয়ের আগে ও পরে
Cyclone Amphan

ত্রাণ দিয়ে আর বাঁধ মেরামত করে সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না

কিছুই সুন্দরবনের ভবিতব্য বদলাতে পারে না। কেন? সংক্ষিপ্ততম উত্তর: কারণ কেউই তা বদলাতে চায় না। 

Advertisement

আদিত্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২০ ০০:০১
Share:

দুর্যোগ মোকাবিলার ওপর বর্তমান গবেষণার একটা বিশেষ দিক হল একটি বিপর্যয় থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি চিহ্নিত করা, যাতে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা যায়।

১১ বছর। আয়লা থেকে আমপান। রাজ্যে ও কেন্দ্রে দুটি সরকারের পরিবর্তন। আর্থসামাজিক প্রগতি এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি। অপরিবর্তিত শুধু সুন্দরবনের মানুষের দুর্দশা ও দুর্গতির মানচিত্র। ঘূর্ণিঝড়ের পর ঘূর্ণিঝড় সেখানে আছড়ে পড়ে, লাখে লাখে মানুষ সীমাহীন দুর্দশায় পড়েন। ইত্যবসরে প্রচুর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, বিশেষজ্ঞদের বিতর্ক, কমিটির পর কমিটির সুপারিশের নথিবন্ধন, পরিবেশবিদদের হাহুতাশ, অসংখ্য গবেষকের গবেষণা ও তার প্রকাশনা চলতে থাকে। গত বিশ বছরে সারা পৃথিবী জুড়ে সুন্দরবন নিয়ে যা গবেষণা হয়েছে, তা একত্রিত করলে ডজনখানেক মহাকাব্য হয়ে যায়।

Advertisement

কিন্তু কিছুই সুন্দরবনের ভবিতব্য বদলাতে পারে না। কেন? সংক্ষিপ্ততম উত্তর: কারণ কেউই তা বদলাতে চায় না।

আয়লা আমাদের দেখিয়েছিল যে ব্রিটিশদের তৈরি করা সুন্দরবনের বসতি আদৌ সুস্থায়ী নয়, এর আশু এবং আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবিলার ওপর বর্তমান গবেষণার একটা বিশেষ দিক হল একটি বিপর্যয় থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি চিহ্নিত করা, যাতে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা যায়। সুন্দরবনের বাঁধ-নির্ভর অস্তিত্ব আর তার ভিত্তিতে এই অঞ্চলের আপাত-স্থিতিশীলতা যে এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে না, তা নিয়ে গবেষক-বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত ছিলেন। আয়লার পর যখন এক দিকে ত্রাণকার্য চলছে, অন্য দিকে চলছিল ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগ এড়ানোর পথসন্ধান। শুধু রাজ্য স্তরে নয়, জাতীয় স্তরে। কিন্তু এই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত কেবল বাঁধ মেরামতের জন্য প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা অনুদানেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: প্রতিস্থাপন হোক, বেশি পাতার গাছও বাড়ুক

এই বাঁধের প্রবর্তন সেই ব্রিটিশ আমলে একেবারেই নিজেদের কোষাগার সমৃদ্ধ করার জন্য। কিন্তু আয়লার পরও সরকারি তরফে আবার সেই বাঁধের মাধ্যমেই সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হল। কারণ সেটাই দস্তুর হয়ে এসেছে, এর থেকে বেশি তলিয়ে ভাবার জন্য, গতানুগতিক উন্নয়নের ধারাকে আমূল পরিবর্তনের জন্য যে ধরনের দৃঢ় সঙ্কল্প ও চিন্তনের প্রয়োজন তার ভয়ানক অভাব। বাঁধ বানালে সবারই সুবিধা— সরকারি কর্মচারী, ইঞ্জিনিয়র, আমলা, ঠিকাদার, রাজনৈতিক দাদাদিদি— সবার। অবশ্য, সেটুকুও হয়নি। আয়লার পর ৭৭০ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্নির্মাণের জন্য বরাদ্দ এই বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে গত ১১ বছরে মাত্র ১০০ কিলোমিটারের কম বাঁধ পুনর্নির্মাণ করা গেছে। কারণ সহজেই অনুমেয়।

এই প্রসঙ্গে নেদারল্যান্ডস-এর একটি প্রকল্পের উদাহরণ দেওয়া যায়— ডেলটা প্ল্যান। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সুন্দরবনের আংশিক সাদৃশ্য রয়েছে। ২০০০ সালে এই প্রকল্প গৃহীত হয়, যাতে স্থির হয় যে ভবিষ্যতের বিপদ থেকে বাঁচতে হলে সময় থাকতে থাকতেই বেশ কিছু অঞ্চলের অধিবাসীদের সরিয়ে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে মানুষের কাছে তুলে ধরেন জলবায়ু পরিবর্তনের যাবতীয় পূর্বাভাস এবং তার থেকে নেদারল্যান্ডস কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তার ধারণা। বলা হয়, ‘জলকে জমি ছাড়ো’ নীতি মানা না হলে জল ঠিকই তোমাকে গ্রাস করবে। উন্নত আর ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ১০ বছর লেগে যায় নেদারল্যান্ডসের এই মানুষগুলিকে বোঝাতে যে তাঁদের নিজেদের সুরক্ষার জন্যই এই পদক্ষেপ। তার পর এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। যদিও নেদারল্যান্ডসে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা, ভুমিক্ষয়, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির হার সুন্দরবনের চাইতে অনেকটাই কম।

সুন্দরবনে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের বাস, যাঁদের মধ্যে ২০ লক্ষ অতি অসুরক্ষিত, বিশেষত যাঁরা দ্বীপগুলির বাসিন্দা। এঁদের সিংহভাগই প্রান্তিক মানুষ। এই বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের পুনর্বাসন খুব সহজ কথা নয়, বিশেষ করে আমাদের মতো রাজনৈতিক দুর্নীতিপ্রবণ দেশে। কিন্তু যদি আমরা সুন্দরবনকে বাঁচাতে চাই, তা হলে এ ছাড়া গতি নেই। আমাদের উদ্যোগ, উদ্যম আর সর্বোপরি অর্থনৈতিক অনুদান সেই দিকে বিনিয়োগ করতে হবে। এই প্রসঙ্গে কিছু সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র দেখিয়েছে যে অর্থনৈতিক ভাবেও এই প‌শ্চাদপসরণ বিনিয়োগ হিসেবে অনেক বেশি দূরদর্শী।

নিত্যনৈমিত্তিক দুর্যোগ সুন্দরবনের অধিবাসীদের কাছে প্রায় দৈনিক সংগ্রামের ব্যাপার। আজ আমপান অথবা ১১ বছর আগে আয়লা নিয়ে হইচই হয়, কারণ এগুলো অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু এই ১১ বছরে আরও বহু বার সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সেগুলির সম্মিলিত ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। কয়েকটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে একশোর বেশি মাঝারি থেকে বড় প্লাবনের ঘটনা ঘটেছে, যার প্রত্যেকটিতে প্রায় ১০,০০০ থেকে ৪০,০০০ বাসিন্দা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে সমুদ্র বা নদীগর্ভে। অসংখ্য পরিবার গৃহহারা হয়েছে, বিস্তীর্ণ চাষের জমি, মাছের পুকুর ইত্যাদি ব্যবহারের অযোগ্য হয়েছে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইত্যাদির তথ্য সম্বলিত করে দেখা যাচ্ছে, ১১ বছরে সামগ্রিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা (২০১৫ সালের অঙ্কে)।

যেহেতু এই ক্ষতি অনেকটা সময় ধরে বিস্তৃত, তাই এই হিসেব আমাদের ভাবায় না বা উন্নয়নের নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে না। এই ক্ষতির হিসাবের মধ্যে, বলে রাখা ভাল, লক্ষাধিক মানুষের দীর্ঘমেয়াদি ক্লেশ, যন্ত্রণা, বিপত্তি, সংগ্রাম ইত্যাদির কোনও রকম প্রতিফলন নেই। তাঁরা প্রান্তিক, তাঁদের দুঃখদুর্দশা আমাদের বিচলিত করেও না, নীতিনির্ধারণে পরিবর্তন তো দুরের কথা। সর্বোপরি রাজনৈতিক শক্তি থেকে দালালদের নিয়মিত রোজগার বন্ধ হয়ে যায় তা হলে।

এই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন প্রকল্প। আমাদের দেশের দুর্যোগ মোকাবিলার প্রক্রিয়াটি নিতান্তই প্রতিক্রিয়াভিত্তিক (রিঅ্যাক্টিভ), স্বতঃক্রিয় (প্রোঅ্যাক্টিভ) নয়। মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো এখন বিপর্যয় মোকাবিলার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে বিবেচিত, যার অর্থ নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে সবচেয়ে অসহায় ও প্রান্তিক মানুষদের অধিকতর সক্ষম করে তোলা, যাতে তাঁরা সহজে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেন। তাঁদের মানবসম্পদ বিকাশ থেকে পুঁজির জোগান সুনিশ্চিত করা, যাতে প্রতি বার বিপর্যয়ে তাঁদের নতুন করে সর্বস্বান্ত না হতে হয়। সরকারের ত্রাণ-ভিত্তিক বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা কেবল মানুষের তাৎক্ষণিক দুর্গতিতে খানিক প্রলেপ লাগায়, কিন্তু তাঁদের প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে কোনও রকম সাহায্য করে না। গত ১১ বছরের দৈনন্দিন বিপর্যয়— যার সংখ্যা একশোর বেশি— সুন্দরবনের মানুষদের সেই প্রতিরোধক্ষমতা তৈরিই হতে দেয়নি। বড়-ছোট বিপর্যয়ের এই সম্মিলিত আক্রমণে তাঁরা এমন ভাবেই কাহিল যে একটি বিপর্যয়ের রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আর একটি বিপর্যয় তাঁদের ধরাশায়ী করে দেয়। সর্বোপরি, এ বার তাঁদের শিয়রে সংক্রান্তি, কারণ প্রতি বিপর্যয়ের পরে সুন্দরবনের মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্যে দেশের দিগ্বিদিকে পাড়ি দেন। এ বার কোভিড-১৯ সংক্রমণের জেরে সেটাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। ফলে আত্মনির্ভর হয়ে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, যেটুকু ক্ষয়ক্ষতি তাঁরা পুনরুদ্ধার করতে পারতেন, এ বার তাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। ফলে দুর্দশা আরও ভয়ঙ্কর ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা।

আমপানের ক্ষতে সাময়িক মলম লাগিয়ে এই সমস্যা মিটবে না। তার জন্য বৃহত্তর পরিকল্পনা, সুদূরপ্রসারী চিন্তা প্রয়োজন। তারও আগে প্রয়োজন পাল্টে দেওয়ার ইচ্ছেটুকু।

হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement