বরেণ্য চলচ্চিত্র শিল্পী। ফাইল চিত্র
গত শতকের চারের দশকের মাঝামাঝি ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’। উপন্যাসটি বিভূতিভূষণ শেষ করেননি। শেষ না করার কারণ হিসাবে বিভূতি গবেষকেরা অনুমান করেছেন, উপন্যাসটি পত্রিকার চাপে পড়ে লেখা। সেভাবে আগাম প্রস্তুতি লেখকের ছিল না। এবং উনিশশো তেতাল্লিশের মন্বন্তরকে উপন্যাসের প্লট হিসাবে বাছলেও, তা ছিল লেখকের অভিজ্ঞতার অনেকটাই বাইরে। কারণ যে বছরে মন্বন্তরে বিপর্যস্ত সমস্ত বাংলা, সে বছরটি ছিল বিভূতিভূষণের ভ্রমণব্যস্ত বছরগুলোর একটা। পূর্বপ্রস্তুতি না থাকা এবং অভিজ্ঞতার বাইরে বাছা প্লট, এই দুইয়ের জন্য বিভূতিভূষণ উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত টানতে নাকি উৎসাহ হারিয়েছিলেন।
কারণ যাই হোক, এই অসমাপ্ত উপন্যাসটি অনেকদিন পর্যন্ত সমালোচকদেরও আনুকূল্য পায়নি। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বিভূতি রচনাবলির ভুমিকায় লিখেছিলেন, ‘‘ইহার ঐতিহাসিক মূল্য থাকিলেও ইহার সাহিত্যমূল্য নাই বলিলেই চলে।’’ এই মতে পরবর্তীতে অবশ্য সহমত হননি অনেকেই। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসের শিল্পমূল্যকে অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানিয়ে লিখেছেন, ‘‘দুর্ভিক্ষের সেই এগিয়ে আসা, ঘনিয়ে ধরা, তার শ্বাসরোধ করা চাপ এবং তার প্রাণান্তক ছোবল স্তরে স্তরে গঙ্গাচরণের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে।’’
হয়তো এই কারণেই এই উপন্যাস পড়ে পরবর্তীকালে মন ভরে গিয়েছিল আর এক জনের। তিনি সত্যজিৎ রায়। ‘‘এত সুন্দর-একটা ছবি হওয়ার সম্ভাবনা আছে এর মধ্যে’’, বইটা পড়ে উচ্ছ্বসিত সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন সহধর্মিনী বিজয়া রায়কে।
সত্যজিৎ রায়ের বিভূতিপ্রীতি নতুন নয়। তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রাই শুরু হয়েছিল বিভূতিভূষণ দিয়ে। বিজয়া রায়ের কথা থেকে জানা যায়, ‘‘বিভূতিবাবুর বই থেকে ছবি করতে ওঁকে অনেক কম খাটতে হত। দৃশ্যের পর দৃশ্য এমন ভাবে লেখা, মনে হয় যেন ছবির জন্যই লেখক লিখেছেন।’’ এ ছাড়া উপন্যাসের সংলাপ এত বাস্তবধর্মী যে নতুন করে সংলাপ লেখার বিশেষ দরকার পড়ত না।
‘অশনি সংকেত’ থেকে চলচ্চিত্র তৈরির ভাবনাও শুরু হল অচিরেই। ছবি তৈরির জন্য প্রয়োজন লোকেশন। অনেক জায়গা খুঁজে শেষে এই ছবির লোকেশন বাছা হয়েছিল বীরভূমে। বীরভূমের ‘‘শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি একটা গ্রামে গঙ্গাচরণ আর অনঙ্গের বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। বাড়িটা ভাঙা অবস্থায় ছিল, সেটাকে মানিকের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক করে নেওয়া হয়েছিল।’’ লিখছেন বিজয়া। সত্যজিতের সিনেমার কলাকুশলীদের নির্বাচন পরিচালক কীভাবে করেন সে নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে। এই ছবির ক্ষেত্রে ‘‘নায়িকা কাকে নেবেন সেই নিয়ে খুব চিন্তা করছিলেন। শেষে বাংলাদেশের ববিতার ছবি দেখে খুব পছন্দ হল…সৌমিত্র ব্রাহ্মণের চরিত্রে…অন্য চরিত্রের মধ্যে সন্ধ্যা রায়কে ঠিক করলেন ‘ছুটকি’ চরিত্রের জন্য।’ এ ছাড়া আরও দুটি উল্লেখযোগ্য পার্শ্বচরিত্রের জন্য নেওয়া হয়েছিল গোবিন্দ চক্রবর্তী (বুড়ো ব্রাহ্মণ), ননী গঙ্গোপাধ্যায়কে (যদু পোড়া)।
উপন্যাস আর চলচ্চিত্র আলাদা শিল্পমাধ্যম। চলচ্চিত্রে কাহিনিকে বুনতে গিয়ে উপন্যাসের কিছুটা রূপান্তর অনেক সময়েই করতে বাধ্য হন পরিচালক। ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে সব চেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছিল ‘ছুটকি’ চরিত্রে। উপন্যাসে কাপালি বৌ ছুটকি তার প্রিয় মিতা ব্রাহ্মণী অনঙ্গের পরামর্শে ‘আমি যদি খেতে পাই, তুইও পাবি’ শিরোধার্য করে গ্রামে থেকে যাওয়াতেই সম্মতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু চলচ্চিত্রে ছুটকি যখন এসে দাঁড়িয়েছে খিড়কি দোরে অনঙ্গ শুধোয়, ‘কী রে?’ ছুটকি বলে, ‘তুমি সতীলক্ষ্মী বামুনদিদি।’ তারপর অনঙ্গের ঠিক পায়ের কাছে মাটিতে কপাল ছুঁইয়ে বলে, ‘‘আশীর্বাদ করো বামুনদিদি, যেন নরকে গিয়েও দুটি খেতে পাই।’’ ছুটকি অনঙ্গের ‘কেন? তুই কোথায় চললি?’ প্রশ্নের উত্তরে জানায়, সে চলেছে শহরে।
কারণ? ‘খেতে বামুনদিদি, খেতে!’
কোনওটার অভিঘাতই যে কম নয়, তা উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র দুটোই যাঁরা পড়েছেন বা দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন। ঋত্বিক ঘটক ছবির শেষ নিয়ে খুশি হতে পারেননি। যে কারণে ‘অশনি সংকেত’ ছবিকে তিনি বলতেন ‘অশনি সঙ্কট’। তবে খুশি হয়েছিলেন বাংলা ছবির দর্শকেরা।
সত্যজিৎ রায়ের ক্যানভাসে যেন সারা বাংলার সংস্কৃতিই এ ভাবে উঠে আসে। কত ভাবে আমার ফিরে ফিরে দেখি। আমাদের প্রজন্ম সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ধরে রেখেছে তাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার কাহিনি। সত্যজিৎ যে ভাবে তাঁর ছবিগুলো পরপর তৈরি করেছেন, সে ভাবে নয়। আমরা শুরু করেছি, গুগাবাবা, ফেলুদা সিরিজ দিয়ে। তার পরে আমরা তাঁর হাত ধরেই উপনীত হয়েছি অপু ট্রিলজিতে। তার পরে গিয়েছি চারুলতায়। আমরা মন্বন্তর দেখিনি। আমরা যেমন দেখিনি সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী-র সময়টিও। কিন্তু তাঁদের আমরা খুঁজে নিতে পারি। আমরা দেখে নিয়েছি আমাদের অতীত, তাঁর সিনেমায়। আগন্তুক দেখার পরে আমরা জেনে নিয়েছি আমাদের ভবিষ্যৎও, তাঁরই সিনেমায়।
আমাদের বয়সের প্রায় সব বাঙালি যুবকই নিজেদের খুঁজে পেয়েছি অপুর সংসারে। কখনও অপুর গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ায়। কখনও অপুর একটি আশ্চর্য উপন্যাস লেখার ইচ্ছের মধ্যে, কখনও তার সম্পূর্ণ একা হয়ে যাওয়ার মধ্যে আবার, তার ছেলের হাত ধরে সংসারে ফিরে আসার মধ্যেও। আমরা নিখিলেশকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি, যেমন পেয়েছি বিমলা আর সন্দীপকেও। সত্যজিৎ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ আমাদের মনের আকাশের যে বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন, তা সত্যজিৎ চোখের সামনে পর্দায় তুলে আনলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম নিজেদের। ওই যে আমিই হাঁটছি, ওই যে আমিই কথা বলছি। আমিই তো তোপসে হয়ে ফেলুদার সঙ্গে জয়শলমির গিয়েছি, আর একটু বড় আমিও তো অমল হয়ে চারুর হাত থেকে পান নিয়েছি। আমিই তো আগন্তুকে মনমোহন মিত্রকে সভ্যতা নিয়ে অসভ্যের মতো প্রশ্ন করেছি। আর তার উত্তরটাও আমিই দিয়েছি।
হীরক রাজার দেশ দেখে সুসময়ে হেসেছি, দুঃসময়ে শিউরে উঠেছি। একটু অন্য ভাবে ধরলে, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সদ্গতি, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি আমাদের এখনও কখনও হাসায়, কখনও ভয় ধরিয়ে দেয়।
তথ্যঋণ: ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’/ রুশতী সেন। ‘আমাদের কথা’/ বিজয়া রায়। ‘আত্মস্মৃতি’/ সজনীকান্ত দাস। এবং ‘দেশ’ পত্রিকা