প্রতীকী চিত্র।
ভারত-সহ বিশ্বের নানা দেশের শ’দেড়েক গবেষণাকেন্দ্রে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। প্রতিষেধকের মূল্য নির্ধারণ ও বাজার-নিয়ন্ত্রণ নীতি নিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। প্রতিযোগিতা মানেই খেলা। তবে, পাশাপাশি আর একটা ‘গেম’ অপেক্ষা করছে। কোন দেশ গবেষণায় সফল হবে— সেটা জানার পরেই খেলাটা শুরু হবে! প্রথম ব্যবহার্য টিকা বেরোনোর পরেও যে দেশগুলি অকৃতকার্য থাকবে, তারা কী করবে? ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বলে যে দুই রাষ্ট্রনেতা গলা ফাটান, নিজের দেশের গবেষণাগারে টিকা আবিষ্কার না হলে, কী পদক্ষেপ করবেন তাঁরা?
ট্রাম্প হয়তো নরমের যম হয়ে উঠবেন। আমেরিকার টিকা আগে এলে, অন্যদের দিতে না-ও চাইতে পারেন। কিন্তু, ভারতের মতো কেউ যদি জিতে যায়, তখন সেটা আমেরিকার সঙ্গে ভাগ না করলে তিনি ছেড়ে কথা বলবেন না। উল্টো দিকে, ভারতের মতো দেশ ‘আত্মনির্ভর’ হতে পারলে ভাল। না হলে ‘গরিব’ ‘উন্নয়নশীল’ তাসগুলো কাঁদোকাঁদো মুখে বিলেতের সামনে ছাড়লেই, ফতে!
এই সব স্ট্র্যাটেজি সামলাতে অবশ্য আছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তারা। তবে, ট্রাম্পের বকুনিতে তাঁদেরও মাঝে মাঝেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনে হয়। অতএব, টিকা বেরোনোর পরে দেশগুলোর মধ্যে যে গেম চলবে, তাতে আন্তর্জাতিক স্তরে মধ্যস্থতা করার কেউ থাকবে বলে মনে হয় না।
নানা দেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক গেমটা পাঠ্যপুস্তকের ‘প্রিজ়নার্স ডিলেমা’ নামের একটি গেমের সঙ্গে মেলে। এই গেমে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের, এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রনেতাদের, দুটো করে চয়েস— সহযোগিতা (কো-অপারেট) করব, না কি করব না? একবার চয়নেই খেলা শেষ নয়। এর সঙ্গে বহুবার আমাদের মোলাকাত হতে পারে। পরিভাষায় একে বলে ‘রিপিটেড গেম’। জীবনে এই গেমটা হামেশাই খেলছি। কখনও এক জনের সঙ্গেই বারংবার, কখনও বা গোষ্ঠীর অনেকের সঙ্গে। বার বার খেলা বা দেখা হয় বলেই হয়তো সমাজে অন্যদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার বা কো-অপারেট করি। সম্পর্ক, সামাজিকতা, রীতিনীতিও এ ভাবেই গড়ে ওঠে। বয়স্ক সহযাত্রীকে সিট ছেড়ে দিই, দোকানদার যে কোনও খদ্দেরকেই লক্ষ্মীর মর্যাদা দেন। উল্টোটাও খাটে। বন্ধু-পরিচিতের উপর রাগ হলেই কষে গালি দিই না। বদমেজাজের জন্য অন্য বন্ধুরা আমাকে একঘরে করতে পারেন, সেই ভয়ে।
এহেন রিপিটেড গেম কী ভাবে কেউ খেলবে, সেটা ঠিক করা সহজ নয়। দাবার চালের কথা ভাবুন। যে যত ভাল দাবাড়ু, সে তত আগাম প্ল্যান করে— ও এটা করলে আমি ওটা করব ইত্যাদি। কিন্তু, রিপিটেড গেম যদি অনন্তকাল চলে, পরিভাষায় যাকে বলে ‘ইনফাইনাইটলি রিপিটেড’, তবে বিভিন্ন পরিস্থিতির আন্দাজে চালের অসীম লিস্ট বানানো অসম্ভব।
ইজ়রায়েলের তাত্ত্বিক আরিয়েল রুবিনস্টাইন আশির দশকে এই স্ট্র্যাটেজিগুলোর ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, আমাদের আচরণ যান্ত্রিক, অটোমেশন মেনে চলে। এই যন্ত্ররা সহজ, তাদের নিয়মকানুনগুলোও সীমিত। নানা ধরনের যান্ত্রিক ব্যবহারের উদাহরণ আমাদের প্রাত্যহিকতায় ছড়িয়ে— আমার ছোট্ট ছেলেকে বকলেই গোমড়া হয়ে থাকে, তার পছন্দের খাবার দিলেই রাগ জল হয়। কেউ আমার সঙ্গে একবার দুর্ব্যবহার করলে আমি আর কোনও দিন তাঁর মুখ দেখব না, সবই অটোমেটেড স্ট্র্যাটেজি।
গণিতজ্ঞেরা প্রমাণ করে দেখান প্রিজ়নার্স ডিলেমার মতো পরিস্থিতিতে সহযোগিতা বা কো-অপারেট করাটা ‘ইকুইলিব্রিয়াম’ বা সুস্থিতাবস্থাও বটে। সহজ এক যান্ত্রিক নিয়ম মেনে চলে সন্ধি। নিয়মটা হল: যিনি সহযোগিতা করছেন তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করুন, কিন্তু আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী একবারের জন্যও সহযোগিতা না করলে তাঁকে কোনও দিন ক্ষমা করবেন না। ভবিষ্যতে তাঁর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াবেন না। এই স্ট্র্যাটেজিকে বলে ‘গ্রিম ট্রিগার স্ট্র্যাটেজি’ বা সংক্ষেপে ‘ট্রিগার’, এক বার উস্কালেই আপনি যেন ভয়ঙ্কর শাস্তি দেবেন! আর তার ভয়েই আসবে সহযোগিতা।
করোনার টিকা আবিষ্কারের মধ্যেও এই সহযোগিতার সুরটা লুকিয়ে। তাই, দেশনেতারা নিজেরাই একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। টিকা বেরোলেই তো খেলা শেষ নয়। প্রথমে আবিষ্কৃত টিকাটির কার্যক্ষমতা বেশি দিন না-ও চলতে পারে, হয়তো তিন মাস পরেই অন্য টিকা নিতে হতে পারে। ক’দিন পরে প্রথম টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে, তখন অন্য টিকা লাগতে পারে।সেই আশঙ্কাই এই গেমে ‘শাস্তি’-র কাজ করবে। অক্সফোর্ড বা ট্রাম্প যদি প্রথম টিকা আবিষ্কার করে ও ভারতের দিকে ‘ভাগ করার’ সহযোগিতার হাতটি না বাড়ান, তা হলে ভবিষ্যতে আমরাও সহযোগিতা করব না। এই ‘ট্রিগার স্ট্র্যাটেজি’-র ভয়েই রাষ্ট্রনায়করা হাসিমুখে পরস্পর হাত মেলাবেন।
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়