ছবি: সংগৃহীত।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় জানাইল, চিন সংক্রান্ত বিষয়ে পাঠ ও গবেষণারত ছাত্রছাত্রীদের ‘রক্ষায়’ তাহারা একগুচ্ছ পদক্ষেপ করিতেছে। তিন মাস হইল হংকংয়ের উপর নূতন নিরাপত্তা আইন চাপাইয়াছে চিন, পরিণামে হংকংয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যাহত, রাজনৈতিক জমায়েত নিষিদ্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা বিতর্কে অংশগ্রহণ দূরস্থান, রাজনৈতিক বিষয়ে মত পর্যন্ত দিতে পারিতেছে না। গ্রন্থাগারে রাজনীতি-বিষয়ক বই নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখাতেও আপত্তি। কুশাসক আইনের ভাষা ধোঁয়াশাময় রাখে, তাহাতে দমন-পীড়নে সুবিধা। চিনও তাহাই করিয়াছে। শাসকের বিরুদ্ধাচরণ হইতেছে দেখিলে আইনবলে হংকং কেন, যে কোনও স্থানে থাকা নাগরিককে চিন প্রয়োজনে স্বভূমিতে ফিরাইবার ব্যবস্থা করিতে পারে। তাহার পরে কী হইবে ভাবিতেও ভয় হয়, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাই তৎপর হইয়াছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চিনা ছাত্রের সংখ্যা লক্ষাধিক, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বহির্ভূত শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশই ছিল চিনা ছাত্রছাত্রী। স্বদেশে তাহাদের বহু স্বজন-বন্ধু, বিদেশে অনেকেরই গবেষণার বিষয় চিনের রাজনীতি ও সমাজ। শিক্ষার্থী বা তাহার পরিবারের কেহ পাছে চিনের কোপে পড়ে, অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ তাই ঠিক করিয়াছেন, গবেষণাপত্রে শিক্ষার্থীর নাম গোপন থাকিবে। পড়ুয়াদের একত্রে পাঠ বা ‘গ্রুপ টিউটোরিয়াল’ পরিচিত ঘটনা, এখন তাহা হইবে শিক্ষকের সহিত ছাত্রের একক উপস্থিতিতে। শ্রেণিকক্ষের পাঠ রেকর্ড করা চলিবে না। শিক্ষা চলিবে গোপনীয়তা ও সুরক্ষা বলয়ের ভিতরে।
কতটা স্বৈরাচারী হইলে কোনও দেশ চিনের ন্যায় আইন পাশ করিতে পারে, তাহা লইয়া আক্ষেপ অপেক্ষাও জরুরি আলোচ্য, শিক্ষার্থীকে কতটা ভালবাসিলে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় তাহার রক্ষণে এই রূপ উদ্যোগী হইতে পারে। ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যগণ চিনা গবেষকদের সহিত জাতীয় নিরাপত্তা আইন লইয়া আলোচনায় বসিতেছেন। শুধু আলোচনাই নহে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কী উপায়ে ছাত্রছাত্রীদের স্বৈরাচারী আগ্রাসন হইতে বাঁচাইতে পারে তাহার লক্ষ্যে সম্ভাব্য ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা আচরণবিধি গঠনের কাজও হইতেছে। আমেরিকায় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিজ়নেস স্কুল আগেই এই জাতীয় পদক্ষেপ করিয়াছে। কেন ইহারা বিশ্বের সর্বাগ্রগণ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম, বুঝিতে অসুবিধে হয় না। বিদেশি শিক্ষার্থীদের ফি-বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রভূত উপার্জন করে সত্য, কিন্তু অর্থই শেষ কথা নহে। বিশ্ববিদ্যালয় আসলে বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ, বহু মত ও স্বরের মিলনভূমি, যুক্তি ও প্রতর্কের মাধ্যমে নূতন দিগ্দর্শনের পরিসর। বিদ্যাচর্চা, জ্ঞান তথা চিন্তার মুক্ত আবহ সেখানে উদার গণতন্ত্রের পালে বাতাস জোগায়। আমেরিকা বা ইউরোপের বহু দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধাত্রীভূমি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। শিক্ষা-প্রশাসকরা সেখানে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী উভয়ের সম্যক রক্ষণে দৃঢ়নিষ্ঠ, শাসকের রক্তচক্ষুতে থরহরিকম্প নহেন। নাগরিকরাও নিজের ও অন্যের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার বিষয়ে তৎপর ও সহিষ্ণু। ভারত এই আয়নাটি নিজের সামনে ধরিলে পারে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলিয়া গর্বিত দেশের শাসক, শিক্ষায়তন ও নাগরিক, সকলের বাস্তব প্রতিচ্ছবিই তাহাতে ধরা পড়িবে।