বিশ্বে করোনা-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটি ছাড়াইল। মৃতের সংখ্যা বারো লক্ষেরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ চলিতেছে বিশ্বে। দেশে দেশে সংক্রমণ পূর্বের রেকর্ড ছাড়াইতেছে। দ্বিতীয় তরঙ্গেও ইউরোপ হইয়া উঠিয়াছে অতিমারির কেন্দ্রভূমি, আমেরিকায় সম্প্রতি পর পর তিন দিন করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার। ফ্রান্সে চালু হইয়াছে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন— ঘরে বসিয়া সম্ভব নহে এমন কাজের প্রয়োজনে, অত্যাবশ্যক পণ্য ও পরিষেবা লইতে বা জরুরি চিকিৎসার কারণ ব্যতীত নাগরিকদের ঘরের বাহিরে যাওয়া বারণ। পর্তুগালে কার্ফু জারি, সুইৎজ়ারল্যান্ডে সেনা মোতায়েন হইয়াছে, রোগজর্জর ব্রিটেনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দুই-ই দুশ্চিন্তা বাড়াইতেছে। বলা হইতেছে, আগামী বৎসর জানুয়ারির আগে প্রকোপ কমিবে না।
একশত বৎসর পূর্বের ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির দিকে তাকাইলে দেখা যাইবে, সেখানেও আজিকার মতোই সংক্রমণের দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় তরঙ্গও আসিয়াছিল। ১৯১৮ সালের শীতের শুরুতে এমনই এক নভেম্বরেই ফিরিয়া আসিয়াছিল রোগের প্রাদুর্ভাব, উহাই ছিল ভয়ঙ্করতম। বৎসরান্তে এক আমেরিকাতেই মারা গিয়াছিলেন প্রায় সাত লক্ষ মানুষ। সম্প্রতি জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষণা দেখাইয়াছে, এ কালের কোভিড-অতিমারিতে বিশ্বে মোট মৃতের এক-চতুর্থাংশই মারা গিয়াছেন দ্বিতীয় সংক্রমণে। শতবর্ষের তফাতে দুই অতিমারির চরিত্রগত পার্থক্য রহিয়াছে নিশ্চয়, কিন্তু উভয়ের গতিপ্রকৃতি ও প্রসারের বিন্যাস লক্ষ করিয়া বিশেষজ্ঞগণ দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহতার কথা বারংবার বলিতেছেন। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, ইংল্যান্ডে কেন প্রশাসন জনজীবনে বিধিনিষেধের কড়াকড়ি করিতেছে, ফ্রান্সে ইমানুয়েল মাকরঁ কোভিডের সঙ্গে লড়িতে যুদ্ধকালীন তৎপরতার উল্লেখ করিতেছেন, ভোটে জিতিবার উচ্ছ্বাসে রাশ টানিয়া জো বাইডেন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের লইয়া কোভিড টাস্ক ফোর্স গড়ার কথা বলিতেছেন। ভারতে আনলক-পর্বে জনজীবনে স্বাভাবিকতার গায়ে গায়েই চালু হইতেছে সতর্কতর সুরক্ষা ও উৎসব-বিধি।
কী করিতে নাই, তাহা বুঝাইয়া দেয় বলিয়াই অতীতের শিক্ষা জরুরি। শতবর্ষ পূর্বে ভাইরাসের চরিত্র, রোগের উপসর্গ, রোগ ছড়াইবার প্রবণতা বিজ্ঞান সহজে বুঝিতে পারে নাই। টিকা পাওয়া যায় নাই, রোগ-প্রতিরোধী পদক্ষেপ করিতে প্রশাসনকে নাস্তানাবুদ হইতে হইয়াছিল। সেই অবকাশে অতিমারি বিশ্ব জুড়িয়া সংখ্যাতীত প্রাণ লইয়াছিল। আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে সাধারণ মানুষ কোভিড সম্পর্কে কমবেশি অবহিত, রোগ প্রতিরোধে কী করিতে হইবে, তাহা জানা আছে বলিয়াই প্রশাসন ও স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সতর্ক ও তৎপর, এক বৎসর না যাইতেই কোভিডের টিকা হাতে আসিবার খবর মিলিতেছে। শীত আসিতেছে, শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাইরাস বেশি সময় বাতাসে সক্রিয় থাকিতে পারে, ঘরের মধ্যে বা অপর্যাপ্ত বায়ুচলাচলহীন আবহে রোগ ছড়াইবার সম্ভাবনা অধিক। অতিমারিকে জানিবার দৌড়ে এই সময়কাল আগাইয়া আছে, এই বার মানিবার দায়িত্ব। কেবল সেই দায়িত্ব পালনেই দ্বিতীয় তরঙ্গ ভঙ্গ হইতে পারে।