ছবি: এপি।
মহানগর কথাটি বলিলেই মনে যে নামগুলি ভাসিয়া উঠে, নিউ ইয়র্ক তাহার অন্যতম। অনেকের মতে, এমন একটি শহরে কিছু দিন কাটাইলে, জীবনদর্শনই বদলাইয়া যায়। এই শহরগুলিতে মানুষ, জাদুঘর, কাফে, পার্ক, প্রেক্ষাগৃহ, গ্রন্থাগার, বিপণি, যানবাহন মিলিয়া এক আশ্চর্য প্রাণময়তা মহাসমারোহে প্রতিনিয়ত স্পন্দিত হইতে থাকে। সকাল সন্ধ্যায় বিনোদনের অভাব নাই, আলোকোজ্জ্বল পথে বেড়াইলে বা বিশাল শপিং মল-এর গমগমে আবহে কিছু ক্ষণ হাঁটিলেই মন উদ্দীপিত হইয়া উঠে। এইখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা সমান অহঙ্কারে উদযাপিত হয়। অনায়াসে দেখিয়া ফেলা যায় প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্যের মহিমা, আবার পৃথিবীতে কোন নূতন ফ্যাশনের পরিধান, কোন নূতন ধারার নাট্য আন্দোলন উপস্থিত হইল, তাহার সাক্ষী থাকা যায় সে অভিনবত্ব শুরু হইবার প্রাথমিক পর্বেই। নাগরিক সুবিধাগুলি থাকে হাতের নিকটেই, প্রয়োজনে সর্বাধিক দ্রুত পাওয়া যায় পুলিশ বা দমকল বা চিকিৎসকের সাহায্য। তেমন শহরের মধ্যে প্রথম সারির নগর, অনেকের মতে প্রথমতম নগর নিউ ইয়র্ক, আজ শোচনীয় ভাবে আক্রান্ত। তাহার আক্রান্তের সংখ্যা এমনকি কিছু দেশের তুলনায়ও অধিক। আপাতত আমেরিকায় কোভিড-১৯’এ মৃত মানুষের প্রায় অর্ধেক নিউ ইয়র্ক নিবাসী। কেহ বলিতেছেন, নিউ ইয়র্ক সচেতন হইতে বিলম্ব করিয়াছে। ইহাও ভাবিতে হইবে, এমন শহরে সব কিছু বন্ধ করিয়া দিবার যে বিপুল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি, তাহাও কর্তৃপক্ষ বিচার করিতেছিলেন। আবার ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিয়াছে, এইখানে পরীক্ষা শুরু করার ক্ষেত্রে গড়িমসি করিবার, যথেষ্ট পরীক্ষা-সরঞ্জাম না পাঠাইবার।
নিউ ইয়র্কের নিবাসী প্রায় ৮০ লক্ষের অধিক মানুষ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে থাকেন দশ হাজার লোক। আমেরিকার সর্বাধিক জনঘনত্ব এখানেই। ইহার মেট্রোতে চড়িবার সময় প্রতি দিন লক্ষ মানুষ পরস্পরের সহিত ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া চলিতে বাধ্য হন। ফুটপাতেও সহ-পথচারীর সহিত দূরত্ব রাখিয়া চলা প্রায় অসম্ভব। প্রতি বৎসর ছয় কোটি পর্যটক আসেন। নিউ ইয়র্কই, আমেরিকায় বহু পর্যটকের প্রথম প্রবেশস্থান, অর্থাৎ সংক্রমণ এইখান হইতেই প্রথম ছড়াইবার সম্ভাবনা প্রবল। মনে রাখিতে হইবে, এইখানে রহিয়াছে বহু দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও ভিড়গ্রস্ত এলাকা, যেমন ব্রংক্স বা কুইনস, যেখানে এমনিই বহু রোগাক্রান্ত মানুষ রহিয়াছেন, যাঁহারা চিকিৎসার সুবিধা বিশেষ পান না। অর্থাৎ, নিউ ইয়র্কের যাহা ছিল বিশেষত্ব, গর্বের নিশান, প্রধান শক্তি, হয়তো অদৃষ্টের পরিহাসে তাহাই হইয়া দাঁড়াইল সর্বনাশের কারণ। মহানগরে অনেক মানুষ থাকেন, বহু জাতি ধর্ম বর্ণের মানুষ থাকেন। এই শহর হইতে অন্য দেশে যাতায়াতও অধিক হয, অন্য দেশের মানুষও ক্রমাগত আসিতে থাকেন। তাই নগর বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষা, বহু খাদ্যাভ্যাস, বহু ধারণায় পূর্ণ ও জমজমাট থাকে। এইগুলিই তাহাকে দেয় বৈচিত্রের, বিশ্বজনীনতার স্পর্শ, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি। অন্য রকম বহু মানুষ দেখিলে অস্বস্তির পরিবর্তে, আসে সহিষ্ণুতা, ঔৎসুক্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার শিক্ষা। সংস্কারবর্জিত বিশ্বনাগরিক হইবার পাঠ এমন নগর হইতেই লওয়া যায়। কিন্তু এখন দেখা যাইতেছে, এই সংখ্যায় মানুষ না থাকিলে, এত মানুষ বেড়াইতে না আসিলে, বরং সমাবেশ কিছু কম হইলে, কিঞ্চিৎ বদ্ধ এলাকা হইলে, নিউ ইয়র্কের এমন ভয়াবহ বিপর্যয় হইত না। রোগ এমন দ্রুত ছড়াইল নগরের এই উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই। এবং এইখানেই রহিয়াছে করোনা-পরবর্তী যুগের মানসিকতার বিপদের বীজ।
মানুষ এমন মনে করিতে শুরু করিবে না তো, উন্মুক্ত উদার জনসমষ্টির তুলনায়, রুদ্ধ বদ্ধ আঁট-কপাট শহরভুক্ত হওয়াই শ্রেয়? মানুষের ভয় আসিয়া, তাহার হৃদয়ের অবারিতদ্বার মানসিকতাকে খর্ব করিবে না তো? মানুষ তাহার জীবনরক্ষার্থে, এত দিনের অর্জিত মানবিকতা হইতে চ্যুত হইয়া, ভজনা করিবে না তো তীব্র প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে, কেবল স্বার্থসিদ্ধি ও অস্তিত্বযাপনের যূপকাষ্ঠে নিবেদিত হইবে না তো তাহার আদর্শ? জগৎ আসিয়া যে শহরে নিয়ত কোলাকুলি করিত, সেইখানে যদি ঘুরিয়া বেড়ায় কেবল শঙ্কিত ও সন্দেহকণ্টকিত কিছু লোক, অতুলনীয় মহানগরের আলিঙ্গনের অভ্যাস পরিবর্তিত হইয়া যদি তাহার স্থানে আসে দূরত্বকামী দ্বীপের নিষেধ ও প্রত্যাখ্যান, তাহা হইবে অতিমারির সর্বাপেক্ষা কুপ্রভাব। তখন নিউ ইয়র্ক টিকিয়া থাকিবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু প্রবল ভাবে বাঁচিয়া থাকিবে না।