Coronavirus

সুন্দরবনের কপালে কী রয়েছে

এক অচেনা বর্তমান, অজানা ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে এই দেশ ও এই রাজ্য।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২০ ০১:২৩
Share:

বেশ খানিক ক্ষণ পরে গোসাবার ভদ্রলোক ফোন ধরাতে মজা করে জিজ্ঞাসা করা গেল, ‘লকডাউনের মধ্যে বাইরে ছিলেন না কি?’ পেশায় শিক্ষক ও একাধারে স্থানীয় তৃণমূলের দাপুটে নেতার গলায় আশঙ্কার সুর, ‘এখানে কেরল, মুম্বই থেকে শয়ে শয়ে মানুষ এসেছে। কী জানি সুন্দরবনের কপালে কী লেখা আছে!’ সুন্দরবনে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ নিয়ে কমবেশি একই আশঙ্কায় ভুগছেন অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, স্থানীয় মানুষজন।

Advertisement

এক অচেনা বর্তমান, অজানা ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে এই দেশ ও এই রাজ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একুশ দিন স্বেচ্ছা ঘরবন্দি থাকাটাই এখন একমাত্র পথ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন যাতে সমাজের এক জনের থেকে আর এক জন আক্ষরিক অর্থেই দূরে থেকে এই ভাইরাসের ‘ভাইরাল’ হওয়া আটকাতে পারেন, ভাইরাসের আক্রমণ এক থেকে অসংখ্য হওয়ার শৃঙ্খলটা ছিঁড়তে পারেন। কেননা চিন, ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার দ্রুত সংক্রমণ ও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখিয়ে দিয়েছে, ‘বিদেশ থেকে আমদানি’ করার স্তর পেরিয়ে যদি প্রতিবেশী থেকে প্রতিবেশীর সংক্রমণ শুরু হয়, এই অতিমারি কী ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে পারে। ভারতের জনসংখ্যা ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি, চিকিৎসার পরিকাঠামো অনেক দুর্বল। ফলে চিন বা ইটালির পর্যায়ে সংক্রমণ গেলে ক্ষতি যে এ দেশে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি হবে, তা বুঝতে বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আশঙ্কা বিশেষ করে সে সব অঞ্চল নিয়ে যেখানে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব অনেক বেশি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল বা মানুষের সচেতনতার অভাব আছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাইরের বহু মানুষের যাওয়া-আসা আছে। এই তালিকায় সুন্দরবন ওপরের দিকে থাকবে, কারণ উল্লিখিত সব পরিস্থিতিই সুন্দরবনে প্রবল ভাবে বর্তমান। ফলে সুন্দরবন আগামী দিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে, সে আশঙ্কা অমূলক নয়।

পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থান হওয়ার গৌরবের অধিকারী সুন্দরবনের উনিশটি ব্লকে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমেই বাড়তে থাকা আয়লা বা বুলবুলের মতো উঁচু মাত্রার ঝড়ঝঞ্ঝা এবং সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় মতো বিপদে এঁদের একটা বড় অংশ বিপর্যস্ত। চাষবাস বা মাছ ধরার মতো স্থানীয় জীবিকার বেহাল অবস্থা ও কর্মসংস্থানের অভাব তো আছেই। বস্তুত এ অঞ্চল দারিদ্রের মাপকাঠিতে বাকি রাজ্যের তুলনায় দ্বিগুণ দুর্বল। তাই এ অঞ্চলের মানুষের আপাতত প্রধান জীবিকা রাজ্যের বাইরে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করা, বিশেষ করে কেরল, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা, মৌসুনির মতো জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ধাক্কা খাওয়া দ্বীপে মিষ্টির দোকানের বাইরে সাদা কাগজে লিখে দালালরা বাইরের রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বক্তব্য, সুন্দরবনের অন্তত ত্রিশ শতাংশ পরিবারে এমন মানুষ রয়েছেন যাঁরা রাজ্যের বাইরে কাজ করেন, অর্থাৎ এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ। দেশ জুড়ে করোনাভাইরাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এঁদের একটা বড় অংশ সুন্দরবনে ফেরত এসেছেন। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, পাথরপ্রতিমার মতো অঞ্চলে বৃহস্পতিবার অবধি লরি বা ম্যাটাডোরে গাদাগাদি করে ফিরেছেন এঁরা। দেশ জুড়ে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় একাংশ ফিরতে না পারলেও, ফিরে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশি।

Advertisement

এই মানুষদের একটা অংশ যে শরীরে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ফিরছেন না, সেটা কে নিশ্চিত করবে? মনে রাখতে হবে, এদের একটা বড় অংশ কাজ করতেন কেরল ও মহারাষ্ট্রে, যে রাজ্যগুলি এখন পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এটাও মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সব মানুষদের কাজ করতে হয় অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, ফলে এঁদের সংক্রমণের বিপদও বেশি। গঙ্গাসাগরের মতো অঞ্চলে প্রশাসন ও কোথাও কোথাও স্থানীয় মানুষের চাপে হাজার তিনেক এমন মানুষ হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা করিয়েছেন, পাথরপ্রতিমা ব্লকে পরীক্ষা করিয়েছেন প্রায় হাজারখানেক মানুষ, কিন্তু সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে ফিরে আসা মানুষদের মধ্যে পরীক্ষা না-করানোর সংখ্যাই বেশি। এটা জানা যে অনেক ক্ষেত্রেই করোনা সংক্রমণের উপসর্গ প্রকাশ পেতে সময় লাগে। এই মানুষগুলির ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটনা ঘটে এবং তাঁরা ভয় পেয়ে বা অজ্ঞানতার কারণে প্রশাসনকে না জানান, তা হলে কী হবে? আরও বড় প্রশ্ন, যে মানুষদের আদৌ কোনও পরীক্ষা হয়নি, যাঁরা স্রেফ মানুষের মহাসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সংক্রমণ হলে কে কী ভাবে রুখবে? পরিচিত ওই মাস্টারমশাইয়ের কথা অনুযায়ী, গোসাবার প্রায় প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে বাইরে থেকে ফিরেছেন শ’দুয়েক করে মানুষ, যাঁদের কোনও প্রাথমিক পরীক্ষা হয়নি। তাঁদের অনেকেই বাধ্যতামূলক কোয়রান্টিন মানছেন না, আপাত ভাবে উপসর্গ নেই বলে গা-ও করছেন না।

উত্তর সম্ভবত একটাই, প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিক নজরদারি। অবশ্যই প্রশাসনের সঙ্গে তালমিল বজায় রেখে। প্রশাসনের প্রথম কাজ— দ্রুত স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিয়ে, বাইরে থেকে ফেরা মানুষগুলিকে খুঁজে বার করা ও তালিকাভুক্ত করা। তাঁদের কোনও সংক্রমণের উপসর্গ না থাকলে ১৪ দিন ঘরবন্দি থাকার নির্দেশ দেওয়া ও যাতে তাঁরা কোনও উপসর্গ দেখা গেলেই খবর দেন তা সুনিশ্চিত করা। স্থানীয় প্রশাসন মাঠে নামলে কাজটা মোটেই কঠিন নয়, মৌসুনির মতো দ্বীপ ইতিমধ্যেই পুরোটা না হলেও অনেকটা কাজটা করে ফেলেছে। পাশাপাশি প্রয়োজন সুন্দরবনের কয়েক হাজার ‘কোয়াক’ ডাক্তারদের সাহায্য নেওয়া, কারণ মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁদের শরণাপন্ন হন। এই কাজে সুন্দরবনে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।

অর্থাৎ সুন্দরবনে ভাইরাস ঢোকার কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্রও ছেড়ে রাখা যাবে না; কেননা তা সুন্দরবনে বা হয়তো গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে মহাবিপদ বয়ে আনতে পারে। মাঠে নামতে হবে এক্ষুনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement