প্রতীকী ছবি।
সাতসকালে ডোর বেলের শব্দে দরজা খুলতেই একটা হলুদ হাত ভেতরে ঢুকে এল, ‘দাদা!’ নাকে-মুখে উঁচু হয়ে থাবড়া গেড়ে বসা একটা লাল-কালো মাস্ক। ‘কে তুমি ভাই ছিনাথ বহুরূপী?’ প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলাম না। লাল-কালো মুখ আর হলুদ হাত আত্মপরিচয় জানাল, ‘দাদা, আমি সন্তোষ।’
এ বার আমারই লজ্জা পাওয়ার কথা। সন্তোষ আমাদের ফ্ল্যাটের ময়লা নেয়, মাঝে মাঝে বাথরুমও পরিষ্কার করে। মানে, অন্দরমহল অবধি যার অবাধ গতিবিধি, সেই সন্তোষকেই চিনতে পারছি না!
অবশ্য মাস্ক মুখে থাকলে কাকেই বা চেনা যায়! দিন দুই আগে অফিস থেকে ফিরে গ্যারাজে দাঁড়িয়ে আছি, পাশের টাওয়ারের পরিচিত এক ভদ্রমহিলা হাঁটতে হাঁটতে শেষে আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে জানালেন, ‘আরে গৌতমদা, আপনি! মুখে মাস্ক, চিনতে পারিনি।’ কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাট-মালিকরাই পরস্পরকে চিনতে পারছে না, আর সন্তোষ! হায়া-লজ্জা, মানবিকতা-টানবিকতা রাখলে চলবে না, মাস্ক বেঁধে যত দ্রুত সম্ভব, আমাকেও নিয়োনর্মাল হয়ে উঠতে হবে। মুখে গৃহকর্তার গাম্ভীর্যের অদৃশ্য মাস্ক চাপিয়ে গৃহসহায়িকাকে হুকুম করলাম, ‘দিদি, ময়লার বিনটা বার করে দাও।’ সুদৃশ্য লাল-কালো মাস্কটা সন্তোষ কোত্থেকে পেয়েছে, ইচ্ছা থাকলেও জানতে চাইলাম না। এই পৃথিবীতে অনেক জিজ্ঞাসাই সন্তর্পণে চেপে যেতে হয়।
সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফেরার পথে যেমন একটা জিজ্ঞাসা মাথায় চাগাড় দিলেও চেপে দিয়েছিলাম। তিলজলা, রুবি-র কাছে ঘরমুখো মানুষ দাঁড়িয়ে, বাসগুলিতে উপচে-পড়া ভিড়। এই ভিড়ে যাত্রীদের ‘দো গজ কি দুরি’ বজায় রাখা সম্ভব নয় জানি, কিন্তু মাস্ক? লোকে মারা যাবে তো! পরে লক্ষ করেছিলাম, বাসের শেষ লম্বাটে সিটে যাঁরা বসে—কারও কারও মুখে মাস্ক, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। ভিড়ে ঠাসা বাসযাত্রায় বাধ্য হয়ে জামা খুলে রেখেছেন। কলকাতার রাস্তা বুঝিয়ে গেল, অঙ্গবস্ত্রের চেয়েও এক চিলতে মুখচ্ছদ অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
গত যুগে চার অক্ষরের ওই ইংরেজি শব্দটায় মেলায় কেনা ভূতের মুখোশ, ছৌ নাচে রাম-রাবণের মুখ, কত কী বোঝাত! এখন মালুম হয়েছে, সংক্রমণরোধে যে একস্তরীয় বা দ্বিস্তরীয় কাপড় আমাদের নাকে-মুখে গুঁজে বাইরে বেরোতে হয়, তারই নাম মাস্ক। মুখোশ অর্থে ‘masque’ বলে চমৎকার একটি ইংরেজি শব্দও ছিল, এখন সে প্রায় বিস্মৃত। সভ্যতার নিয়মই তা-ই। যাবতীয় বৈচিত্রকে তছনছ করে একটা খোপে পুরে ফেলা। তবে বাংলা ভাষার এই নাকের কাপড়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। চেয়ার, টেবিল, আলমারি, রেস্তরাঁর মতো আর একটি নতুন শব্দ পাওয়া গেল। সবেতেই খারাপ খুঁজতে নেই, বাংলা ভাষা মাস্ক পরে অতিমারিতেও আর একটু আন্তর্জাতিক হয়ে উঠল।
অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করতেও মাস্ক লা-জবাব। লকডাউনের প্রথম পর্বে পরিচিত এক জন থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে, বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরছিলেন। আমাকে বললেন, ‘বাজার গিয়ে দেখুন, বেশির ভাগ লোকেরই মাস্ক নেই।’ সে-সময় টিভি থেকে কাগজ সর্বত্র এক অনুযোগ, আমজনতা বেশির ভাগই দায়িত্বজ্ঞানহীন। লোকে মাস্ক না পরে খেয়ালখুশিমতো ঘুরছে। আমি থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে অন্যরা ঠিকঠাক মাস্ক পরছে না বলে গরমাগরম বক্তৃতা দেব, এটাই বাঙালির মাস্কবাদ।
মাস্ক নিয়ে আরও দর্শনচেতনা লাভ করেছি দিঘার কাছে এক বাজারে ইলিশ কিনতে গিয়ে। ঘরে বসে বিরক্ত হতে হতে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম তাজপুর ও মন্দারমণি সৈকতে। রিসর্টে সকলের মুখে মাস্ক। যে দিন সকালে ফিরছি, সে দিনও কলকাতা-আগত পর্যটকদের গাড়ি একের পর এক ঢুকছে রাস্তায়। সিটে হেলান-দেওয়া পর্যটক থেকে ড্রাইভার, সকলের মুখেই মাস্ক। কিন্তু দিঘা মোহনা, রামনগর ও বালিসাই বাজারে ইলিশের খোঁজে গিয়ে হতবাক! কোনও বিক্রেতার মুখে মাস্ক নেই। এক জন হাসলেন, ‘দূর, এখানে কারও করোনা হয়েছে দেখান তো!’ জানালেন, লকডাউনের প্রথম পর্বে পুলিশি তাড়ায় বাধ্য হয়ে মাস্ক পরতেন। কিন্তু পুলিশের নজরদারির বাইরে আবার যে কে সেই! মফস্সলের এই গরিব মানুষগুলি মাস্ক না পরে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি ঘটাচ্ছেন কি না, জানার সাংবাদিকীয় প্রবৃত্তি হয়নি। চমকেছি অন্য কারণে। রিসর্টের কর্মী ও কলকাতা থেকে গাড়ি চেপে-আসা টুরিস্টদের মুখেই মাস্ক থাকবে? স্থানীয়দের মুখে নয়? অজানতেই দেশে শুরু হয়ে গিয়েছে সদর-অন্দর বা শহর-মফস্সলের মতোই নতুন এক মুখচ্ছদ-ব্যবধান বা মাস্কিং ডিভাইড?
লকডাউনের প্রথম পর্বে মাস্কের কার্যকারিতা অনেক। বিশেষত মদের দোকানে। কাউন্টারের সামনে পিচবোর্ডে আঁকাবাঁকা হরফে লেখা থাকত, মাস্ক না থাকলে পানীয় কেনা যাবে না। সেই সময় লাইনের ভিড় পেরিয়ে পাঁইটটি হাতে পেলে চমৎকার লাগত। উফ্, এই প্রজন্ম বেঁচে গেল! আমাদের প্রথম যৌবনে দোকানের বাইরে এসেও ভয়ার্ত চোখে আশপাশটা জরিপ করতে হত। কাকা-জেঠা কেউ নেই তো! এখন মাস্ক থাকলে কে খুড়ো কে ভাইপো!
কথা হচ্ছিল এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্নপূর্ণাজয়ী পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাসের সঙ্গে। পর্বতশীর্ষের পথে ওঁদের মাস্ক, জ্যাকেট, ধড়াচুড়োগুলি আরও ভারী যে! জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখন কেউ কাউকে চিনতে পারেন কি না! জানালেন, বেস ক্যাম্প বা অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্পে প্রায় এক মাস একসঙ্গে থাকতে হয়। মাস্ক থাকলেও জ্যাকেটের রং, হাঁটার ভঙ্গি দেখে মানুষটাকে চেনা যায়। কমিউনিটি বা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে না থাকলে, চলনবলনের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে মুখোশের আড়ালে আসল মুখটিকে কখনওই চেনা যায় না।
অতএব, তৈরি করো মাস্কগোষ্ঠী। বারাণসীতে ভোটের আগে স্বচক্ষে এবং তার পর আমদাবাদে করোনা-আবহে নমস্তে ট্রাম্প সভায় দেখেছি, কাতারে কাতারে মানুষ। সকলের মুখেই একচ্ছত্র আধিপত্যকামী প্রিয় নেতার মুখের আদলে তৈরি মাস্ক। বাড়ি ফিরে কেউ হয়তো রাজমা খাবেন, কেউ ধোকলা। কিন্তু তাতে কী? সকলের মাস্ক একটা, আইডেন্টিটি একটাই। এক ছাঁচে ঢালা মাস্কই জানিয়ে দেয়, এই দেশে বহুত্ববাদের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে।
কোভিড-দুনিয়ায় মাস্কই একমাত্র আয়ুধ নয়। রাস্তাঘাটে আজকাল অনেক নভশ্চরকে দেখা যায়। মাস্কের উপর স্বচ্ছ একটি ফেস-শিল্ড চাপিয়ে থাকেন। মাস্ক, টুপি ও ফেস-শিল্ড আচ্ছাদিত ওই সহনাগরিকদের দেখে আমার প্রায়ই তরবারি খেলার কথা মনে হয়। লিয়ো তলস্তয়ের আনা কারেনিনা উপন্যাসে তখনকার সংক্রামক পার্পল ফিভার-এর কথা আছে। কিন্তু আনা বা তার প্রেমিক ব্রনস্কি, স্বামী কারেনিন কেউ তরবারি-যুদ্ধের বেশ ধরেছে এমনটা পাইনি। তখন অবশ্য ডাক্তারদের যোদ্ধা বা রোগ থেকে সেরে-ওঠা মানুষটিকে ‘সারভাইভার’ বলার চল ছিল না। একুশ শতকে ভাষাকেও যে যোদ্ধৃবেশে, কত রকম মাস্ক পরানো হয়!
আমাদের মতো আমজনতার পক্ষে কোন মাস্ক সবচেয়ে ভাল? কেউ জানে না। প্রথম পর্যায়ে আদেখলের গাছে লাউ হল, এন-৯৫’এর জয়ধ্বনি উঠল। ডাক্তাররা নাকি হাসপাতালে ওটাই পরেন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাস্ক। দাম পাঁচ-সাতশো। কয়েক দিনেই দেড়শো টাকার নকলও বেরিয়ে গেল, কিনব কি না জানতে চেয়ে ডাক্তার বন্ধুর ধমকও খেলাম, ‘একদম নয়! ওই মাস্ক আমরাই এক ঘণ্টার বেশি পরে থাকতে পারি না!’ ওষুধের দোকান থেকে সছিদ্র বোতামযুক্ত মাস্ক কিনলাম, ক’দিন পরে শুনি সেও যথেষ্ট কার্যকর নয়। বাকি থাকল কাপড়ের মাস্ক। তারও ডাবল লেয়ার, থ্রি লেয়ার হরেক প্রকারভেদ। শোনা গেল, ডাক্তারবাবুরা যা পরেন, সেই সিঙ্গল লেয়ার, ইউজ় অ্যান্ড থ্রো মাস্কই নাকি সবচেয়ে ভাল। তবে কোনও মাস্কই নাকি পূর্ণ বিশ্বস্ত এবং একশো শতাংশ জীবাণুরোধক নয়। বোঝো ঠ্যালা। এই সংসারে কে কাকে কবে পূর্ণ বিশ্বস্ততা দিয়েছে!
সেই অবিশ্বাসী মাস্কই নারীর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। এক গোপন বন্ধুনি হোয়াটসঅ্যাপে কিছু রঙিন মাস্কের ছবি পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোনটা ভাল?’ ফোন করে উত্তর দিলাম, ‘সবই ভাল। কিন্তু ওগুলি যে দিন বরের সঙ্গে বেরোবে, তার জন্য। অন্যদের অজানতে তোমাকে মাস্কহীন, আবরণহীন দেখেই সুখ।’ অন্য প্রান্তে হাসি, ‘আশপাশে বৌ নেই, তাই সাহস বেড়েছে!’ বন্ধুনিদের সঙ্গে এই সব সঘন মাস্কহীন মুহূর্তের জন্যই মুখোশধারী পৃথিবীটা এখনও সহনীয় লাগে।
আমাদের সেই মুহূর্ত এসেছিল কলকাতার উপান্তের রিসর্টে। এখন ওই সব জায়গায় রিজ়ার্ভেশন থাকলেও মুখে মাস্ক সাঁটতে হয়, চেক ইনের আগে দ্বাররক্ষী স্যানিটাইজ়ার দেন এবং থার্মাল গানে তাপমাত্রা মেপে নেন। এই সব ঝঞ্ঝাট আগে ছিল না।
বন্ধুনি বন্ধ ঘরের সোফায় এলিয়ে বসে মাস্কটা বিছানায় ছুড়ে দিলেন, ‘বাঁচা গেল। এত ক্ষণ মাস্ক পরে দম আটকে আসে। তোমার হাঁসফাঁস লাগে না?’
রাষ্ট্র এবং সমাজের বিধিনিষেধ তো এই সময়েই নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করা যায়! এখন আমার কোনও অসুখ নেই, কোনও মাস্ক নেই।