অতিমারির সঙ্গে লড়তে গিয়ে সব কিছু এত দ্রুত করতে হচ্ছে যে মনে হতে পারে, লম্বা পরিকল্পনা করে আটঘাট বেঁধে তবে নামব, এমন সুযোগ বুঝি সরকারের নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও রোগমুক্তির ক্ষেত্রে এ কথাটা সত্যি হতে পারে। কিন্তু, কোভিড-১৯-সংক্রান্ত অন্য বিষয়গুলির ক্ষেত্রে সে যুক্তি পুরোপুরি খাটে না। সে সব ক্ষেত্রে যে কিঞ্চিৎ ভাবনা এবং আলাপ-আলোচনার অবকাশ রয়েছে শুধু তা-ই নয়, তা আবশ্যকও বটে।
যেমন অর্থনীতির বিষয়টি। সরকার কী কী করতে পারে, সে প্রশ্নে নানা মত উঠে আসছে, কিন্তু একটা মূল সুর যেন থাকছেই— এই জ্বলন্ত সমস্যাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হবে, সে বিষয়েও বিশেষ দ্বিমত নেই। মাননীয় অর্থমন্ত্রী অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে উদ্দীপকের কথা বললেন বার কয়েক। এই উদ্দীপকের উল্লেখে আশঙ্কা হয়, তাঁর দৃষ্টি ব্যবসার কাপ্তেনদের ছাড়িয়ে বেশি দূর যেতে পারছে না। আশঙ্কাটি আরও পোক্ত হয়, যখন দেখি এই অদ্ভুত সময়েও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের শুধু সুদ কমানোর কথাই মনে পড়ে। মন্ত্রী যখন এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকা খরচের কথা ঘোষণা করলেন, এবং সে খরচ যে নীচের তলার মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার লক্ষ্যে, খানিক আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল, পরিমাণটি প্রয়োজনের তুলনায় নিদারুণ রকম অপ্রতুল। আইএলও-র এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত প্রায় চল্লিশ কোটি ভারতীয় দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাবেন কোভিড-১৯-এর ফলে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষিত অঙ্কের অন্তত চার গুণ পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এই মানুষগুলিকে চরম দারিদ্র থেকে বাঁচাতে।
অর্থমন্ত্রী হয়তো শীঘ্রই দ্বিতীয় দফার অর্থ বরাদ্দ ঘোষণা করবেন। কিন্তু সে অর্থ আসবে কোথা থেকে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যথাসম্ভব অল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ধার নিতে হবে, আর কিছুটা আসবে অনুদান থেকে। এ ছাড়া অন্য বিকল্প বিশেষ নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে (‘ব্যবসার লাভের অংশ..., আবাপ ১৮-৪) কৌশিক বসু ‘অংশীদারি অর্থনীতি’র ধারণার কথা বলেছেন, যেখানে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভের অংশ সরকার নিয়ে গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দেবে। এই বণ্টনের প্রয়োজনীয়তাটি যে এই বিপর্যয়ের সময়েই বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিকতা পেল, তা নয়। অধ্যাপক বসু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আগে থেকেই তা ভাবার দরকার ছিল ক্রমবর্ধমান আর্থনীতিক অসাম্যকে কিছুটা বাগে আনতে, অন্যথায় তা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। আর এই মুহূর্তে তো এ ধরনের আর্থিক পুনর্বণ্টনের কথা ভাবতেই হবে।
আরও পড়ুন: মরিয়া পরিযায়ীদের যন্ত্রণা দেখিয়ে দিল, ধনতন্ত্র কী বস্তু
এখানেই খটকা লাগছে। কোভিডের ধাক্কায় যখন অর্থনীতি টলোমলো, তখন ব্যবসায় লাভও খুব অনিশ্চিত, তাই না? এমতাবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের জন্যে সরকারি সাহায্য চেয়ে জোরালো দাবি উঠছে বণিকমহল থেকেই। তাঁরা এরই মধ্যে বড় রকমের করছাড়ের আশা করছেন। ফলে কৌশিকবাবুর প্রস্তাব এই বিশেষ সময়ে বাস্তবায়িত হওয়া একেবারেই অসম্ভব, যদিও অর্থনীতি খানিক সামলে ওঠার পর তা সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু লাভের ওপর কর না বসিয়ে বিত্তবানদের সম্পদ বা ‘ওয়েলথ’-এর ওপর যদি কর বসানো যায়? অন্তত এক বারের জন্যে সম্পদ কর? এর পক্ষে কিছু যুক্তি দেওয়া যায়। এখানে সে চেষ্টাই করব।
ভারতে ব্যক্তিমালিকানায় সম্পদ রয়েছে কত, সহজে জানার উপায় নেই। তবু সরকার চেষ্টা করলে পরোক্ষ পদ্ধতি প্রয়োগে সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় বিত্তবানদের তালিকা অবশ্য সহজেই পাওয়া যায়— যেমন, ফোর্বস বা ‘হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট’ ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়। শেষোক্ত তালিকায় দেখছি ২০১৯ সালে ৯৫৩ জন এমন ভারতীয় ছিলেন, যাঁদের প্রত্যেকের ‘নেট ওয়ার্থ’ (অর্থাৎ দায় বাদ দিয়ে সম্পদের মূল্য) ১০০০ কোটি টাকার বেশি। তালিকার শীর্ষে আছেন মুকেশ অম্বানী— তাঁর ৩,৮০,৭০০ কোটি টাকার ‘নেট ওয়ার্থ’ সহ। এই ৯৫৩ জনের মোট সম্পদের মূল্য ৫০.৩ লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র তিন শতাংশ হারে কর বসালেও শুধু এই শীর্ষস্থানীয় বিত্তশালীদের থেকেই আসবে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা। এর পর যদি তালিকা ধরে ক্রমান্বয়ে নামতে থাকি, এবং প্রগতিশীল করব্যবস্থা অনুসারে ৫০০ থেকে ১০০০ কোটির সম্পদে দুই শতাংশ হারে এবং ১০০ থেকে ৫০০ কোটির সম্পদে এক শতাংশ হারে কর আরোপ করা যায়, আরও কয়েক লক্ষ কোটির সংস্থান হবে।
সম্পদ কর ভারতে নতুন ধারণা নয়, বহু বছর ধরেই ছিল। ২০১৫ সালের বাজেটে অরুণ জেটলি এর বিলোপ করেন। অতি সম্প্রতি ইউরোপের জন্যে তিন বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী সম্পদ করের কথা বলেছেন, যার অনুসরণে এস সুব্রহ্মণ্যম ভারতের জন্যেও একই ধরনের প্রস্তাব করেছেন।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ‘পিএম-কেয়ার’ নামে পৃথক তহবিল খুলে সেখানে দান করার আহ্বান জানান। অনেক বিত্তবান স্বেচ্ছায় সেখানে বড় অঙ্কের অর্থ দান করেছেন, এবং দেশবাসীর জ্ঞাতার্থে তা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েও দিয়েছেন। বিপর্যয়ের সময়ে সরকার কী করছে, এটাই যেহেতু মনোযোগের প্রধান বিষয় হয়ে থাকে, সরকারও সচেষ্ট থাকে এমন সব পদক্ষেপ করতে, সাধারণ মানুষের কাছে যার দৃশ্যমানতা বেশি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট এবং বিত্তবান মানুষ যখন বড় অঙ্কের চেক নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং তা সচিত্র সংবাদ হয়ে প্রচারিত হয়, তা সরকারের পাশে থাকার বিজ্ঞাপনও হয়ে যায়, যা শাসক দলকে তৃপ্তি দেয়। বিপন্ন মানুষকে সাহায্যের সচিত্র বিজ্ঞাপন সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের কাছে রুচিহীন মনে হতে পারে, কিন্তু অভ্যস্ত চোখে তেমন পীড়া দেয় না। আর, এক জনের দান দেখে অন্য অনেকে উদ্বুদ্ধ হলে তাতে লাভ বই ক্ষতি নেই। বিপর্যয়ের সময়ে পরার্থপরতা কিংবা পরহিতৈষণা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মানবিক গুণ বলে বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে। সামর্থ্য অনুসারে বা সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও অন্যের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় অনেককেই।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই স্বতঃপ্রবৃত্ত দান রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের বিকল্প হতে পারে না। আর সেই কর্তব্যপালনে প্রশাসনিকতার সঙ্গে মেশাতে হবে ন্যায্যতার সুস্পষ্ট ধারণা। রাষ্ট্রকেও নাগরিকদের থেকেই অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, যদি না দেশের বাইরে থেকে বিপুল অনুদান পাওয়া যায়। কিন্তু তা ন্যায্যতার নীতি মেনেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সম্পদ কর কতটা ন্যায্য, যখন সম্পদশালীদের অনেকেরই বর্তমান আয় তলানির দিকে।
এই কোভিড-১৯ অতিমারির ঋতুতে যেটা বিশেষ ভাবে লক্ষ করার মতো, তা হল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিছুটা হলেও নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতার একটা ধারণা নিয়ে ভাবছেন এবং তাঁদের আচরণে তার প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে। কেউ যখন শুধুমাত্র নিজের স্বার্থহানির দিকে আঙুল তুলে ‘বঞ্চনা’র কথা বলে, তাকে ঠিক ন্যায্যতার ধারণা বলা চলে না। কিন্তু মধ্য বা উচ্চবিত্ত বাড়ির কাজে নিযুক্ত কর্মীদের প্রায় সর্বত্রই যে বেতন-সহ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে একটা ন্যায্যতার ধারণা আছে। যে ডাক্তারবাবুর চেম্বার এক মাসের ওপর বন্ধ হয়ে আছে, এবং ফলত রোগী দেখে আয় শূন্য, তিনিও কিন্তু চেম্বারের সহকারীটিকে মাসমাইনে দিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে, ‘আমার রোজগার হচ্ছে না অতএব তোমাকেও দিতে পারব না’— এমন যুক্তি তাঁরা দিতেই পারতেন, কিন্তু দিচ্ছেন না। অতএব ধরে নিতে পারি, সম্পদ করের অন্তর্নিহিত যে ন্যায্যতার ধারণা, অধিকাংশ মানুষের তাতে সমর্থন থাকবে। অর্থনীতিকে বিপর্যয় থেকে তুলতে যে নীতিই ভাবা হোক না কেন, ন্যায্যতার ধারণাটি তার কেন্দ্রে থাকতেই হবে, কারণ সরকারি অনুশাসনের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা নির্ভর করে জনমানসে রক্ষিত ন্যায্যতার ধারণার ওপর।
রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস মনে পড়ে গেল। ‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তকমা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল’। রাজ-তকমা-পরা চাপরাশির ভয় এবং তা থেকে উদ্ভূত আক্রোশ দূর করতে রাষ্ট্রের মানবিক মুখটি যেন সব শ্রেণি থেকেই সমান দৃশ্যমান থাকে এটা নিশ্চিত করতে হবে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
আরও পড়ুন: উহান তো আমাদেরই কীর্তি