সন্তানের সামনে মোবাইল ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে বাবা-মাকেও। ছবিটি প্রতীকী। —নিজস্ব চিত্র
মুকুট পরা করোনাভাইরাসের ছবি এঁকেছে তিথি। বাড়ির কেবল টিভির ঝোলা তারে দোল খাওয়া দোয়েল পাখিটার ছবিও আঁকা হয়েছে। আরও কত কিছু এঁকেছে টুকটাক। আর ভাল লাগছে না তিথির। এবার আঁকতে বললে রেগে যাচ্ছে। জোর করলে রং-তুলি দিয়ে খাতায় যা খুশি টান দিয়ে রেখে দিচ্ছে। তিথি কিন্তু স্কুলের এবং এলাকার বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় সব সময়েই পুরস্কার পায়।
কবিতা লেখা এবং আবৃত্তিতে বেশ নাম অভিরূপের। নতুন কিছু লিখলে মাকে শোনায়। কলেজের বন্ধুরা যে কোনও অনুষ্ঠানে ওর কবিতা চায়। মা তা নিয়ে মনে মনে গর্বিত। কিন্তু ক’দিন ধরেই অভিরূপ জানিয়েছে, তার মাথায় কোনও শব্দ নেই। সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। ছেলের কথায় ভয় পেয়ে গিয়েছেন মা।
লকডাউনে ঘরবন্দি জনতা। কাটছে না সময়। সময় কাটাতে বেড়েছে স্মার্টফোনের ব্যবহার। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকে স্থির চোখ। বড়দের পাশাপাশি শামিল ছোটরাও। এতে সৃজনশীলতায় কোপ পড়ছে না তো? করোনা আতঙ্কে ২৪ মার্চ থেকে চলছে লকডাউন। ছুটি স্কুল, কলেজও। গুজবের জেরে অনেক জায়গায় বন্ধ সংবাদপত্র বিলিও। ফলে বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সহজ মাধ্যম স্মার্টফোন। ঘরে বসে বিনোদনের মাধ্যমও ওই তালুবন্দি খুদে যন্ত্রটি। যন্ত্রটির বেশি ব্যবহারে ক্ষতি তো হচ্ছেই। তমলুক সাইবার ক্রাইম থানা সূত্রে খবর, ফেসবুকে করোনা সংক্রান্ত ফেক নিউজ ছড়ানোর জন্য গত দু’সপ্তাহে জেলায় অসংখ্য মামলা হয়েছে। এ তো বড়দের দিক থেকে ক্ষতি। কিন্তু ছোটদের সেই ক্ষতির রূপ কত দিকে? সৃজনশীলতায় হানা দিচ্ছে না তো বন্দি সময় আর সময় কাটানোর উপায়!
লকডাউন পর্ব চলাকালীন সমাজ মাধ্যমে মানুষের সময় কাটানো অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। বড়-ছোট সকলেরই একই দশা। মোবাইল ফোনে কার্টুন দেখা, গেম খেলায় মেতে উঠেছে খুদেদের একাংশ। ঘরবন্দি অবস্থায় ছোটদের হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিতে অনেক অভিভাবকই সাহস পাচ্ছেন না। কোলাঘাটের দেড়িয়াচকের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক কার্তিক সাহু বলেন, ‘‘লকদাউনের সময় থেকে বাড়িতে সংবাদপত্র আসছে না। তাই আগের থেকে অনেক বেশি সময় চোখ রাখতে হচ্ছে মোবাইলে।’’ পাঁশকুড়ার পশ্চিম বাকুলদা গ্রামের অভিভাবক রঞ্জিত ঘোষ বলেন, ‘‘স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়ির ছোটরা ঘরবন্দি। খেলার মাঠেও যেতে পারছে না। পড়ার সময়টুকু বাদে টিভি আর মোবাইলে চোখ। কয়েকবার নিষেধও করেছি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ওরা কী বা করবে!’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশি সময় ধরে মোবাইল ব্যবহার করলে হতাশা তৈরি হয়। শিশুদের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। তমলুকের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অলোক পাত্র বলেন, ‘‘আমরা এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছি তাতে স্মার্টফোন লাগবেই। তবে দিনে এক ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করলে তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বেই। অত্যধিক স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে যেমন ব্রেন টিউমার হওয়া, ঘুম কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়, তেমনই এর ফলে হতাশা বাড়ে, মনোসংযোগের ব্যাঘাত ঘটে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। শিশুদের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। আগামীদিনে মূলস্রোতে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে।’’ কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? চিকিৎসক অলোক পাত্রের মতে, ‘‘ছোটদের ঘরের মধ্যে রেখেই সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। বড়রা যদি মোবাইলে চোখ না রাখে ছোটরা সাহস পায় না। এ জন্য এই সময় বড়দের উচিত ছোটদের বেশি করে সময় দেওয়া।’’
বন্দি সময় আর সৃজনশীলতা নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের ভাগবতচরণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সারা বছর ছাত্রদের পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল চিন্তা বা প্রতিভার খোঁজে নানান কর্মসূচি নিত। পড়ুয়ারা শিখত চিঠি লেখা। যোগ দিত প্রবন্ধ, অঙ্কন, ক্যুইজ প্রতিযোগিতায়। চলত মনীষীদের জীবনী চর্চা থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণ। তাতে আপাতত ভাটা পড়েছে।
তবে লকডাউনের কারণে সৃজনশীলতা একেবারে কমে যাবে বলে মনে করেন না বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ দাস। তাঁর মতে, ছোটরা সব সময়েই বড়দের থেকে অন্যরকম চিন্তা ভাবনা করে। এই সময়ে ধরা বাঁধা জীবন থেকে অনেকটা স্বাধীনতা পেয়েছে তারা। শুধু হাতের কাজ, কবিতা, গান, আবৃত্তি বা অন্য কিছু দিয়ে সৃজনশীলতার ব্যাখ্যা করা যাবে না। একজন পড়ুয়া এই সময় তার প্রকৃতি ও পরিবেশ পর্যবেক্ষণ থেকে সবকিছু ভাল করে পাঠ নিতে পারছে। নিত্য নতুন অনুভূতি জাগছে। সেটাও তো সৃজনশীলতা। যার প্রতিফলন আগামী দিনে ঘটতে বাধ্য। কিন্তু এই ছুটি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে ছোটদের মনে প্রভাব পড়তে বাধ্য। আবার বিপথেও চালিত হতে পারে। ফলে এই সময় বাবা, মায়ের সতর্ক থাকা জরুরি।
প্রধান শিক্ষকের মত, বেশি মোবাইলে অভ্যস্ত হয়ে পড়া এবং তাতেই সময় কাটানোয় সৃজনশীলতা নষ্ট হতে পারে। তাদের অবসাদ যাতে গ্রাস না করে সে দিকে বড়দের সতর্ক থাকতে হবে। গ্রামাঞ্চলের স্কুলের পক্ষে পড়ুয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করাও কঠিন। সেই পরিকাঠামো বা প্রযুক্তি এখনও পড়ুয়াদের মধ্যে সুলভ নয়। পড়ুয়ারা তাতে অভ্যস্তও নয়। জেলা পুলিশের তরফে অঙ্কন এবং হস্তশিল্পের যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে অনেকেই যুক্ত হতে পারলেও সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই অসুবিধের মধ্যেও ইতিবাচক দিক রয়েছে বলে মনে করছেন অরবিন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘আগে সময় নেই কথাটা পড়ুয়াদের মুখে লেগেই থাকত। এখন অনেক সময় তাদের হাতে। ফলে চিন্তা ভাবনার অখণ্ড অবকাশ। অনেকটা মুক্তি, স্বাধীনতা পেয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে জমানো কথাটা হয়তো শেয়ার হচ্ছে না। তবে নিজেকে নতুন করে তৈরি করার এটা একটা সময়। প্রকৃতি থেকেও তো অনেকটাই শেখা যায়।’’
বন্দি সময় আর সৃজনশীলতার কোনও বিরোধ নেই। মনে করেন মানসিক রোগ চিকিৎসক তথা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার সিদ্ধার্থশঙ্কর দাস। তাঁর কথায়, ‘‘যদি শিল্পী-সাহিত্যিক বা চিত্র পরিচালকদের জীবনী পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে তাঁরা অনেক সময়েই সৃষ্টির কাজে মগ্ন থাকার জন্য নিভৃতবাসে চলে যেতেন। সৃজনশীল পড়ুয়াদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি তাই। তারা এই সময়টা নানা ভাবেই কাজে লাগাতে পারে।’’ তবে একটি বিষয়ে চিকিৎসক সিদ্ধার্থশঙ্কর সাবধান করে দিয়েছেন। যে পড়ুয়ার মনের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্কের উপাদান আগে থেকেই ছিল তাদের হয়তো এই সময়ে তা প্রকট হতে পারে। তবে তা নিয়ে অহেতুক চিন্তার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। উদ্বেগ, আতঙ্ক কাটাতে তাদের যা শখ, যা ভাল লাগা সেই সব বিষয়ে চর্চার সুযোগ তৈরি করে দিতে বলছেন এই চিকিৎসক।
সুতরাং, বন্দি সময়ে মনের আগল খুলতে হাতে থাক রং-তুলি। মন খুঁজুক শব্দ। কবিই তো বলেছেন মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ‘আড়ালে তার সূর্য হাসে’।
তথ্য সহায়তা: বিশ্বসিন্ধু দে
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)