চাকরিসূত্রে দিল্লিতে বদলি হয়ে আসা বারো বছর আগে। কিন্তু এখনও কলকাতাতেই ভোটার তালিকায় নাম। দিল্লির ভোটার নই। লোকসভা ভোটই হোক বা দিল্লির বিধানসভা ভোট, আম আদমি পার্টির নেতারা প্রচারে বেরিয়ে তাই বাড়ির দরজায় কলিং বেল বাজান না। বেশির ভাগ নির্বাচনের সময়ই কলকাতায় ভোট দিতে যাওয়া হয় না। তাই তৃণমূল, বিজেপি বা সিপিএম নেতাদের কাছেও কদর নেই। তাঁরা কেউ ফোন করেও বোঝানোর চেষ্টা করেন না, ভোটটা কোন দিকে যাওয়া উচিত। বেশ বোঝা যায়, ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও ভোটার হিসেবে কোনও মূল্য নেই।
দেশ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখে এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন, মানুষগুলোর কি কোনও মূল্য নেই? উত্তরটা বোধ হয়, এঁদের ভোটার হিসেবে কোনও মূল্য নেই।
জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ নিজের স্থায়ী ঠিকানা বা জন্মভিটেতে থাকেন না। কেউ বিদেশে, কেউ অন্য রাজ্যে, কেউ নিজের রাজ্যে থাকলেও গ্রাম ছেড়ে বড় শহরে। এঁদের একটা বড় অংশ আবার কয়েক মাসের জন্য বা কয়েক বছরের জন্য অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। আবার ফিরে আসেন। এঁরাই পরিযায়ী শ্রমিক। এঁদের সংখ্যা কত, তার কোনও সরকারি গণনা নেই। কেউ ভাবেননি।
এঁদের গ্রামের বাড়ির ভোটার তালিকায় নাম থাকে। কিন্তু ভোটের সময় তাঁরা অন্য শহরে কাজে আটকে থাকেন। শুধু ভোট দিতে টাকা খরচ করে বাড়ি ফেরার অর্থ বা তাগিদ তাঁদের থাকে না। যদি না কোনও রাজনৈতিক দল উদ্যোগী হয়ে তাঁদের ফেরানোর বন্দোবস্ত করে। কিন্তু সবাই তো আর একই এলাকার ভোটার নন। ফলে ঘরে ফিরলেও যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভোটের অঙ্ক বদলে দিতে পারেন, এমন নয়। আর পেট চালাতে যে শহরে মাথা গুঁজতে হয়, সেখানে তো ভোটার তালিকায় নামই ওঠে না। ভোটের রাজনীতির ভাষায়, পরিযায়ী শ্রমিকেরা ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ নন। ‘সুইং ভোট’ও নন। তাই তাঁদের ‘ভ্যালু’ নেই।
চার বছর আগে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক নিরথ গায়কোয়াড় ও গ্যারেথ নেলিস ভারত জুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক নেতারা বিশ্বাস করেন যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কান্নাকাটি করলেও তাঁরা চোখ-কান বুজে থাকতেই পারেন। কারণ, ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া এই শ্রমিকদের খুব সামান্য অংশই ভোট দেন। ফলে এঁদের সাহায্য করে বিশেষ রাজনৈতিক ফায়দা মিলবে না।
গত পঞ্চাশ দিনে এটাই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়েছে। শ্রমিকদের নিয়ে পিংপং খেলা চলছে। ২৫ মার্চ লকডাউন জারির পরে দিল্লির শ্রমিকেরা বাড়ির পথ ধরেছিলেন। রুটিরুজি বন্ধ। আবার কবে রোজগার মিলবে, জানা নেই। গ্রামে ফেরার ট্রেন-বাস নেই। তাই হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা হেঁটেই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবালের সরকার ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই বসেছিল। ওঁরা যে দিল্লির ভোটার নন। ওঁরা থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী!
২৭ মার্চ নরেন্দ্র মোদীর সরকার নির্দেশ জারি করে, এ ভাবে যাওয়া চলবে না, ভাইরাস ছড়াবে। চল্লিশ দিন পরে সেই নিয়ম উল্টে ট্রেন-বাস চালু হয়ে গেল। কবে ট্রেন-বাস মিলবে, মিললেও টিকিটের টাকা জোগাড় হবে কি না, তা ভেবে শ্রমিকেরা আবারও হাঁটা শুরু করলেন। কোনও দিন হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনেই শুয়ে পড়লে ট্রেনের চাকায় শরীরগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কোনও দিন হাইওয়ের ধারে ট্রাকের চাকা পিষে দিল। তাতে কী? কোনও মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, এখন শ্রমিকদের ফেরানো যাবে না। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলে রাজ্যের মুখে চুনকালি পড়বে। কোনও মুখ্যমন্ত্রী আবার বলছেন, শ্রমিকদের যেতে দেওয়া চলবে না। লকডাউন ওঠার পরে কাজ করবে কে?
ওঁদের নিয়ে বোধ হয় এমন ছিনিমিনি খেলাই যায়। কারণ ওঁরা তো শুধুই পরিযায়ী শ্রমিক। ভোটের বাজারে গুরুত্বহীন।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের হিসেব দেখা যাক। দেশের নথিভুক্ত ভোটারের সংখ্যা ৯১ কোটির বেশি। তার মধ্যে ২৯ কোটির বেশি মানুষ ভোট দেননি। অনেক দেশে এত ভোটারই নেই। পাঁচ বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক, ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জিতে আসার নির্বাচন। ৮৩ কোটির বেশি নথিভুক্ত ভোটার ছিলেন। তার মধ্যে প্রায় ২৮ কোটি মানুষ ভোট দেননি। এঁদের অনেকেই হয়তো ভোটের দিন গড়িমসি করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আর লাইন দেননি। কিন্তু অনেকে নিজের এলাকায় ছিলেনই না।
রাজ্যভিত্তিক হিসেব দেখলে ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়। বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া মানুষের সংখ্যা চির কালই বেশি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি নথিভুক্ত ভোটারের মধ্যে ৬ কোটির কাছাকাছি ভোট দেননি। বিহারে ৭ কোটির বেশি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ভোট দেননি। ২০১৫ সালে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর একটি রিপোর্ট বলছে, যে রাজ্য থেকে বাইরে কাজ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি, সে রাজ্যের ভোটের হার কম।
কখনও পরিযায়ী শ্রমিকেরা নিজেরাই ভোটের বিষয় হয়ে ওঠেন। তাঁরা ভূমিপুত্রদের রুটিরুজিতে ভাগ বসাচ্ছেন বলে আঙুল ওঠে। স্লোগান ওঠে, বিহারি খেদাও বা বাঙালি খেদাও। মহারাষ্ট্র কিংবা উত্তর-পূর্বের একাধিক রাজ্য, এমন নজির অনেক রয়েছে। তবে ভোটার হিসেবে পরিযায়ী শ্রমিকদের কদর একমাত্র তখনই বাড়ে, যখন অল্প ভোটের ফারাকে খেলা ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই লোকসভা ভোটের চেয়ে বিধানসভা বা পুর-নির্বাচনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের বেশি খোঁজ পড়ে। কারণ সেখানে অল্প ভোটের ব্যবধানেই ফল বদলে যায়।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট এর আদর্শ উদাহরণ। ভোটের আগে বামফ্রন্ট সরকারের পতন যখন প্রায় দেওয়াল লিখনের মতো স্পষ্ট, তখন সিপিএম নেতারা খড়কুটোর মতো এই পরিযায়ী শ্রমিকদের আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। সুশান্ত ঘোষের মতো তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা দিল্লির করোলবাগের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বাঙালি শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা যেন রাজ্যে গিয়ে কাস্তে-হাতুড়িতে ভোটটা দিয়ে আসেন। এ কথা টের পেয়ে সে সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডান হাত এবং অধুনা বিজেপি নেতা মুকুল রায়ও একই ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
কেরলের কোচি শহরের কাছে পেরুমবাভুরে হাজার হাজার বাঙালি শ্রমিকের বাস। বাংলায় বিধানসভা ভোটের সময় পেরুমবাভুর থেকে মালদা, মুর্শিদাবাদের বাস ছাড়ে। বলা বাহুল্য, যাত্রার খরচ জোগান কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারাই। আড়াই হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ। শারীরিক কষ্ট হলেও গরিব মানুষগুলো আপত্তি করেন না। ভয় পান, যদি ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে যায়! কিংবা, যদি রেশন কার্ড বাতিল হয়ে যায়! শুধু বাংলা নয়, সব রাজ্যেই পরিযায়ী শ্রমিকদের মনে এই ভয় থাকে। তাঁরা যে আসলে ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’। ভোটার হিসেবে তাই তাঁদের দাম নেই।