বিপন্ন অবস্থায় নিজেদের ঘরে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করা নিরুপায় শ্রমিকদের দুরবস্থাকে একটি শব্দবন্ধে চিহ্নিত করে স্বাভাবিকতা দেওয়া হয়।
পরিযায়ী শ্রমিক। কী করে তৈরি হল শব্দবন্ধটা? পরিযায়ী তো কিছু বিশেষ পাখি! ঋতু আর উষ্ণতাভেদে স্থান বদলের জীবনচক্রই তাদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মানুষ? বছরের বিভিন্ন সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত কি তার জীবনচক্রের স্বাভাবিক নিয়ম? তা তো নয়। মানুষকে এমন যাতায়াত করতে হয় জীবিকার কারণে। দিনমজুর বা অন্য রকমের শারীরিক শ্রম বিক্রেতাদের এটাই ললাট লিখন। এই শব্দবন্ধ তাঁদেরই চেনায়। উচ্চশিক্ষার খাতিরে বা ভাল-খারাপ চাকরি নিয়ে যাঁরা অন্যত্র থাকেন, মাঝেসাঝে বাড়ি আসেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু এই শব্দবন্ধ প্রযোজ্য নয়! নতুন শব্দ তৈরি হলে, বাংলাভাষী হিসেবে খুশির কথা। আপত্তি করার কথা নয়। কিন্তু এই শব্দযোজনায় বড়ই বিষণ্ণতা। কোথায় যেন নিজের বসত ছেড়ে অনেক দূরের অঞ্চলে জীবিকা সন্ধানে যাওয়া, তার পর বিপন্ন অবস্থায় নিজেদের ঘরে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করা নিরুপায় শ্রমিকদের দুরবস্থাকে একটি শব্দবন্ধে চিহ্নিত করে স্বাভাবিকতা দেওয়া হয়।
বলা হচ্ছে, নিজেদের রাজ্যে ‘মনরেগা’ বা একশো দিনের কাজের মজুরি কম, তাই বেশি মজুরির টানে শ্রমিকেরা দূরের রাজ্যে গিয়েছিলেন। সত্যিই কি তাই? কয়েক জন হয়তো স্বেচ্ছায় অন্য রকম কাজ, বিশেষত লেখাপড়া শিখে নাগরিক জীবিকা মারফত উপার্জনের জন্য দূরে গিয়েছেন। সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য। বাকি রইলেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। অধিকাংশই গত ৩০-৩৫ বছরে জমি বা জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষ দেশের নয়া কৃষি ব্যবস্থার সৌজন্যে জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত। অন্যদের অনেকেই নদীবাঁধ, রাস্তা তৈরি, নগরায়ণ ইত্যাদি কারণে জমি বা প্রাচীন জীবিকা হারিয়েছেন। বাড়ি, গ্রাম, পরিবার ছেড়ে (বা অনেকের ক্ষেত্রে পরিবার সমেত) চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যেখানে গিয়েছেন, সেখানে অভ্যস্ত কাজ পাননি। যা পেয়েছেন, যতই বিপজ্জনক বা গ্লানিকর হোক, তা-ই করেছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। গ্রাম উজাড় করে গিয়েছেন শহরগুলোয়। বেশির ভাগ খনি শ্রমিক, রং মিস্ত্রি, নির্মাণকাজের মজুর। গৃহপরিচারিকা ছাড়া মেয়েরাও অধিকাংশ তা-ই। অথচ পুরনো জীবনে খুব কম জনই সে কাজ করতেন। অল্প জনই স্বেচ্ছায় গাঁ-ঘর ছেড়েছিলেন।
১৯৯২-’৯৩ সালে মালদহের পঞ্চানন্দপুরে গিয়েছিলাম। ছোট বাজারেই ১১টা সোনার দোকান! সবই স্থানীয়দের। সেগুলো চলতও। তখনই অধিবাসীরা গঙ্গার ভাঙনে বিপন্ন। ২০০৩-’০৪ সালে এলাকাটাই গঙ্গার গর্ভে। ফরাক্কা ব্যারাজ হওয়ার পর ভাঙনের জন্য যাঁরা পাঁচ, সাত এমনকি বারো বার ঘর ছেড়েছিলেন, তাঁরা কে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন, কেউ হিসেব রাখেনি। তার আগেই স্থানীয়রা বলেছিলেন, বম্বের গয়নাপট্টি জ়াভেরি বাজারে গিয়ে ডাকবেন, ‘পঞ্চানন্দপুরের কে আছ?’ অর্ধেক বাজার উঠে দাঁড়াবে। ২০০৭-এ জ়াভেরি বাজার অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের অন্তত চার জন ছিলেন মালদহের।
আরও পড়ুন: পুলিশবাহিনীর চোখে আজও কৃষ্ণাঙ্গ মানেই সন্দেহভাজন
বীরভূমের জনজাতির এক মেয়ে বিয়ের পর মা-বাপের ভিটে-জমি ছেড়েছিলেন। নানা পথ ঘুরে ভিটেয় ফিরে দেখেন, সেখানে বড় রাস্তা চলে গিয়েছে। বাড়ির চিহ্নও নেই। সাধারণ রাস্তা ক্রমশ আশি ফুট চওড়া হয়ে শিলিগুড়ি ছাড়িয়েও গিয়েছে অনেক দূর। দু’পাশের গ্রাম উপড়ে আবর্জনার স্তূপ। হাওড়া, হুগলি, ২৪ পরগনার গ্রাম আর দুর্বলের ভিটে গিলে নিয়েছে কত শহর। ‘ধানখেত করতেই হবে’র জেরে বীরভূমের বিখ্যাত উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো মাঠগুলো বর্ধমানের মতো সপাট সমতল। সমস্ত ঝুরো মাটি নেমে এসেছে নদীর খাতে। যে এলাকা বন্যা কী জানতই না, ১৯৭৮-এর পর থেকে সে-ও প্রতি বছর প্লাবনে উথালপাথাল হয়েছে, যত দিন না তার নদীগুলো একেবারে মাঠের সমান হয়ে যায়। বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় চাষের খেত আর জঙ্গল হারিয়ে গিয়ে হয়েছে পাথরখাদান। পুরুষেরা শরীর বেচতে গিয়েছে এক ভাবে। লক্ষ লক্ষ মেয়ে আর এক ভাবে। পয়সার আশায় গিয়েছিলেন সবাই? স্বেচ্ছায়? মানলাম যে কেরল, বেঙ্গালুরু, নয়ডায় মজুরি বেশি। কিন্তু প্রাণধারণের খরচ? বাংলার চেয়ে, নিজের ঘরের চেয়ে অনেকটাই বেশি নয় কি?
আরও পড়ুন: বাংলায় এখনও বিজেপি কোনও বড় আইকন-নাম পায়নি
জনজাতির মানুষেরা কিছুতেই নিজেদের সমাজ ছেড়ে থাকতে চান না। তাঁদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব সামাজিক অস্তিত্বের সঙ্গে অনেকখানি মিলেমিশে থাকে। ৪০ বছর আগে জনজাতির মানুষেরা চাষের সময় ‘পুবে খাটতে’ যেতেন বর্ধমান-হাওড়া-হুগলিতে। দল বেঁধে যেতেন, দল বেঁধেই থাকতেন। কাজ শেষে ঘর-পরিবারে ফিরতেন। গ্রামের সকলেই তো চাষ করেন না। যাঁরা চাষ করেন, তাঁদের ঘরে নানাবিধ বস্তু, অন্য উপকরণও লাগে। সেখানেও কিছু জীবিকাহীনকে কাজ দেওয়ার অবকাশ থাকে। বরাবরই অভাবের সময় কিছু লোক বাইরে খাটতে যেতেন। ফিরতেন ঋতু পাল্টালে।
গত দু’মাস কত মানুষ খালি হাতে, খালি পায়ে ঘরে ফিরলেন। বাধ্য হয়ে বেচতে গিয়েছিলেন শ্রম, মেধা, নিজেদের দিনরাত্রি। ফিরছিলেন নিরুপায়ে, অনাহারে। অনেকেই ফিরে যেতে চান না ওই দুঃস্বপ্ন যাত্রায়। কিন্তু নিজের মাটিতেও এঁরা থাকতে পাবেন তো? ‘পরিযায়ী’ বলে দেওয়ার পর, নিজেদের মাটি ঘর-শেকড়ের স্বীকৃতি থাকে তো কোথাও?