—ফাইল চিত্র।
পরিদর্শনের কাজটির মধ্যে যদি রীতি বা নীতি ভঙ্গ করিবার ঝুঁকি না থাকে, তাহা হইলে পরিদর্শক আসিবার মাত্র পনেরো মিনিট পূর্বে আগমনবার্তা জানাইবার প্রয়োজন হয় না। অথচ এই রাজ্যে কেন্দ্রের পরিদর্শনকারী দল আসিবার সময় তাহাই ঘটিল। তাঁহারা রাজ্যে আসিবার তিন ঘণ্টা পর সংবাদ পাইলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। যু্ক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে রাজ্যের সহিত কেন্দ্রের আচরণবিধি ইহা নহে। যে কোনও রাজ্যের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিদর্শন করিবার, তাহার ত্রুটি সম্পর্কে রাজ্যকে সচেতন ও সতর্ক করিবার অধিকার অবশ্যই কেন্দ্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রহিয়াছে। এবং রাজ্য সরকারের কর্তব্য, কেন্দ্রের পরিদর্শনে সহায়তা করা। অথচ রাজ্যে কেন্দ্রীয় দলের আসিবার যুক্তি, পরিকল্পনা, কিছুই আগাম জানানো হইল না। রাজ্যের আধিকারিকদের সহিত যোগাযোগ না করিয়াই তাঁহারা বিভিন্ন জেলা পরিদর্শন করিতে গেলেন। মনে হইতেই পারে, রাজ্য সরকারের উপর কেন্দ্রীয় দলটির আস্থা নাই বলিয়াই এমন কার্যপদ্ধতি। মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ অসঙ্গত নহে। প্রশ্ন কেবল প্রশাসনিক রীতিনীতির নহে। রাজ্যগুলির ত্রুটিবিচ্যুতি যাহাই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্য পরিষেবা শেষ অবধি জোগাইতে হইবে রাজ্য সরকারকেই। লকডাউন কার্যকর করিয়া মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও রাজ্যেরই। অতএব রাজ্যকে সঙ্গে লইয়া পরিদর্শন করিলে আখেরে রাজ্যেরই সুবিধা হইবার কথা। পরিবর্তে রাজ্যকে ধোঁয়াশায় (বা অন্ধকারে) রাখিয়া অনুসন্ধানে আসিয়া কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা কোন উপকারটি করিলেন?
কেন এমন গোপনীয়তা, সে প্রশ্নের পাশেই আর এক রহস্য—কেন পশ্চিমবঙ্গ? কোন কারণে কেন্দ্রীয় দলের পরিদর্শনের তালিকায় অন্যান্য অনেক রাজ্যের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ স্থান পাইল? জাতীয় স্তরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিস্তারের যে চিত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে এই প্রশ্নটি বিলক্ষণ ভাবাইতেছে। মোট সংক্রমণের হিসাব লইলে ভারতে পশ্চিমবঙ্গ এখন ত্রয়োদশ স্থানে। চব্বিশ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাইয়াছে, অথবা যত দিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হইতেছে, কোনও হিসাবেই পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষের কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে নাই। তৎসত্ত্বেও কেন এই রাজ্যে তড়িঘড়ি পরিদর্শক পাঠাইতে হইল? যদি রাজ্যের সহিত আগাম আলোচনা করিয়া কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দলটি আসিত, তাহা হইলে কেন্দ্রের যুক্তিগুলি জানিবার সুযোগ থাকিত। তথ্য নাই, অতএব ঝাঁক বাঁধিতেছে সন্দেহ যে, কারণটি আসলে রাজনৈতিক। যে চারটি রাজ্যে কেন্দ্র সোমবার পরিদর্শক পাঠাইয়াছে, তাহার মধ্যে তিনটিতে (মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গ) বিজেপি ক্ষমতায় নাই, একটিতে (মধ্যপ্রদেশ) অতি সম্প্রতি ক্ষমতায় আসিয়াছে। অথচ গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ-সহ বেশ কিছু বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সকল সূচকেই সংক্রমণের পরিস্থিতি অধিক গুরুতর। তবে কি মহামারির পরিস্থিতি পরিদর্শনের তুলনায় বিরোধী দলগুলিকে অদক্ষ বলিয়া দেখাইবার আগ্রহটিই এখানে বড়?
দুর্ভাগ্যজনক বলিলেও কম বলা হয়। দেশে এখন ভয়াবহ পরিস্থিতি। এই বিপুল বিপন্নতার সম্মুখে দাঁড়াইয়া একটি নির্বাচিত সরকার এমন ক্ষুদ্র স্বার্থে কাজ করিতে পারে, যেন বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আপ্তজন বলিয়াছেন, মরিলেও স্বভাব যায় না। রাজনীতির দানে প্রতিনিয়ত অপর পক্ষের ঘুঁটি কাটিবার যে অভ্যাস নেতারা রপ্ত করিয়াছেন, মৃত্যুভয়ও তাহা হইতে নিরত করিতে পারে না। চরম সঙ্কটের মুহূর্তে বিজেপিরই এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাঁহার দলের এক মুখ্যমন্ত্রীকে উপদেশ দিয়াছিলেন রাজধর্ম পালন করিতে। সে দিনের সেই মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, আজ সেই উপদেশ মনে রাখুন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আপাতত মুলতুবি রাখিয়া, মহামারি মোকাবিলায় রাজ্যগুলির সহিত পূর্ণ সহযোগিতাই আজিকার রাজধর্ম।
আরও পড়ুন: নীতিকে ন্যায্য হতেই হবে