দ্রুত হারে গলছে কুমেরুর হিমবাহ। ছবি: এএফপি
বিশ্ববাসী বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মনে করছেন গবেষণাগারে আর সামরিক অস্ত্র তৈরি না করে মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে জীবাণুদের প্রতিষেধক ও ওষুধ তৈরির দিকে নজর দেওয়া হোক। প্রশ্ন জাগছে, এই ঘটনা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলশ্রুতি নয় তো?
আমরা জানি, সেই আদিকাল থেকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। মানুষ কখনও প্রতিষেধকের মাধ্যমে, কখনও বা ওষুধের মাধ্যমে দমন করেছে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে। পেনিসিলিন আবিষ্কারের আগেও আমাদের হাতে ছিল প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকের ভাণ্ডার। ব্যাকটেরিয়া-সহ অণুজীবগুলি সেই অ্যান্টিবায়োটিককে জয় করে নতুন ভাবে উপস্থিত হয়েছিল। ফলে জীবশ্রেষ্ঠ ও অণুজীবদের লড়াই সেই আবহমান কালের। কিন্তু যারা আগে মানুষকে তাদের শত্রু বলে ভাবত না, তেমন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া যখন মানুষকে আক্রমণ করল তখনই দেখা দিল এক নতুন বিপদ। ফের ঘনিয়ে এল মহামারির আশঙ্কা।
তবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি কিন্তু বদলে দিতে পারে পরবর্তী সময়ের বাস্তুতন্ত্র ও অণুজীববিদ্যা চর্চার অভিমুখ। এত দিন জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, অরণ্য নিধনের মতো ঘটনার প্রভাব আলোচনায় আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ থাকত বৃহদায়তন প্রাণীদের দিকে। জীবাণু বা অণুজীবদের কথা এত দিন সে ভাবে ভাবা হয়নি। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, এই জীবাণুজগত পৃথিবীর জীবশক্তির অন্যতম ভাণ্ডার। ন’টি দেশের ৩০ জন অণুজীববিজ্ঞানী ‘নেচার’ পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁদের অভিমত, মানুষ যে অসংখ্য জীবাণু ও তার বৈচিত্রকে এত দিন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে তারাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত। এই জীবাণুগুলি যেমন সমুদ্রের অতল গভীরে থাকতে পারে, তেমনই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে থাকতে পারে মেরু এলাকার বরফের মধ্যেও।
প্রথমে আলোচনা করা যাক, সামুদ্রিক অণুজীবদের নিয়ে। সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে এই অদৃশ্য অণুজীবগুলির সংখ্যা প্রায় ১X১০৩০ (ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়া) এবং এদের জীবভর সমুদ্রের মোট জীবভরের ৯০ শতাংশ। এবং পৃথিবীর সব মানুষের জীবভরের তুলনায় এক হাজার গুণ বেশি। এদের মধ্যে উদ্ভিদ জাতীয় অণুজীবগুলি সূর্যালোকের মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় শক্তি সঞ্চয় করে। এই উদ্ভিদ অণুজীবগুলি সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের প্রথম সদস্য। এদেরকে খেয়ে বেঁচে থাকে ক্রিলেরা। ক্রিলেদের খেয়ে বেঁচে থাকে মাছ।
সমুদ্রে দিনের পর দিন বর্জ্য পদার্থ ফেলায় সর্বপ্রথম এরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদের ক্ষতি সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক দশকে প্রবল সামুদ্রিক দূষণের কারণে সমুদ্রের জলে অতিরিক্ত পুষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার ফলে বাড়তে থাকে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাও। নতুন জন্মানো ব্যাকটেরিয়াগুলি ব্যবহার করতে থাকে সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন। তখন দেখা দেয় সঙ্কট। অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছেরা। সমুদ্রের কোথাও তাপমাত্রা -২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কোথাও আবার রয়েছে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট রয়েছে। এই কারণেই, সমুদ্রের বিপুল জীববৈচিত্র রয়েছে। বরফযুক্ত স্তরে রয়েছে এক ধরনের শৈবাল। যারা খাদ্যশৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত। যদি এই বরফ গলতে থাকে তা হলে কিন্তু এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে এবং তার বিরূপ প্রভাব পড়বে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রভাবে সমুদ্রের অম্লত্ব যদি আরও বাড়ে, এখন যে বৃদ্ধির হার ০.৩ থেকে ০.৪ একক, তা হলেও, প্রচুর অণুজীবের ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার গবেষক রিক কাভিকোচিওলি তো মনে করেন, এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের জীবগোষ্ঠী এক দিন অনাহারে
মারা যাবে।
এ বার আসা যাক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যুগ যুগ ধরে জমা বরফ, যাকে পার্মাফ্রস্ট বলে, তার গলে যাওয়া এবং তার মধ্যে থাকা জীবাণুদের কথায়। কুমেরু ও সুমেরু তাপমাত্রা প্রায় তিন গুণ বেড়ে গিয়েছে। কুমেরু অঞ্চলের অনেক হিমবাহের বয়স প্রায় কয়েক লক্ষ বছর। কয়েকটি হিমবাহ তো আবার বয়সে প্রায় ৮০ লক্ষ বছরের পুরনো। গবেষক জন প্রিসকু এমনই হিমবাহের মধ্যে কোটি কোটি জীবাণুর হদিশ পেয়েছেন। কয়েকটি জীবাণুকে সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে বৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর দাবি, মেরু অঞ্চলের বরফের স্তূপ নানা রোগজীবাণুর আধার। সেখানে এমন জীবাণুও রয়েছে যারা ৪০ লক্ষ বছরেরও পুরনো। মেরু অঞ্চলের মৃত্তিকা ও বরফের স্তরে বহু রোগসৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। কিন্তু এখানকার উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বরফের গলনের ফলে তারা স্বাভাবিক কার্যকারিতা ফিরে পেতে পারে। এবং সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কারণ, মৃত মানুষ ও প্রাণীদের বরফে কবর দেওয়ার প্রথা বহু পুরনো। ‘হোমিনিন’ (মনুষ্যগোত্রীয়) গোষ্ঠীর নিয়ান্ডারথাল, ডেসিনোভ্যান প্রজাতি প্রথমে বসিতে স্থাপন করেছিল সাইবেরিয়ায়। এদের শরীরে নানা ভাইরাসের সংক্রমণ ছিল। গবেষক জন মিচেল ৩০-৪০ হাজার বছর আগেকার সেই জীবাশ্ম থেকে বেশ কিছু ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন। তাঁর দাবি, পৃথিবী থেকে ভাইরাসদের নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন না দেখাই ভাল। বরং দরকার মানুষের আবিষ্কৃত প্রতিষেধকগুলির যথাযথ সংরক্ষণ। কারণ, এই ভাইরাসদের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে এরা মানুষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলের কবরখানা থেকে পাওয়া গিয়েছে একটি ভাইরাসের আরএনএ-র ভগ্নাংশ। যেটি ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু সৃষ্টিকারী ভাইরাসের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। ফলে যদি বরফাবৃত অঞ্চলের বরফ স্তর গলতে শুরু করে তা হলে আঠারো ও উনিশ শতকের মহামারি সৃষ্টিকারী বহু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার পুনরুত্থানের আশঙ্কা রয়েছে। যেমনটি ১৮৯০ সালে সাইবেরিয়ায় স্মলপক্সে আক্রান্ত হয়ে একটি শহরের ৪০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ঠিক এমনি একটি ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে সাইবেরিয়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে সংক্রমণ হয়েছিল অ্যানথ্রাক্স রোগের। দেখা গিয়েছিল এই অ্যানথ্রাক্স রোগের সূত্র হল ৭৫ বছর আগের একটি রেনডিয়ার। যেটি এই রোগে মরা যায়। তার মৃতদেহ বরফে কবর দেওয়া হয়েছিল। সে বার গ্রীষ্মে বরফের স্তর গলে যাওয়ায় মৃতদেহটি অনাবৃত হয়ে পড়ে এবং জীবাণুরা মাটি, জল হয়ে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে।
বিশ শতকের গোড়ায় উত্তর রাশিয়ায় কয়েক লক্ষ রেনডিয়ার অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। তাদের বেশিরভাগকেই ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে সমাধিস্থ করা হয়। তা গলে ঘটাতে পারে অনেক বিপত্তি। এমনিতেই গ্রীষ্মের সময়ে বরফাবৃত অঞ্চলের উপরিভাগের প্রায় পঞ্চাশ সেন্টিমিটার বরফ গলে যায়। কিন্তু আরও গভীরতায় থাকা বরফের স্তর গলে গেলে রোগ জীবাণুর প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে যাবে। গবেষকদের আশঙ্কা ইতিমধ্যেই হয়তো তা হয়েছে। হয়তো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে আরও বড় ধরনের মহামারির মৃত্যুবীজ।
এই বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে সম্প্রতি যে চিত্রটি সামনে এসেছে তা কিন্তু খুবই ভয়ের। কারণ নাসার বিজ্ঞানীরা আলাস্কার হিমবাহে ৩২ হাজার বছরের ঘুমন্ত ব্যাকটেরিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছেন। এটির নাম কারনোব্যাকটেরিয়ামা প্লিসটোনিয়াম। এটা প্লিস্টোসিনি যুগে হিমায়িত হয়েছিল। নোভাসিরিক্স শহরের গবেষণাগারে কর্মরত বিজ্ঞানীরা প্রস্তর যুগের মানুষের শরীরের জীবাণুর হদিশ পেয়েছেন। দেখা গিয়েছে হিমবাহের ভিতরে অণুজীবের সঙ্গে উনিশ শতকে রাশিয়ার মহামারিতে মৃত মানুষজনের দেহে থাকা ভাইরাসের সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
একই ভাবে পুনরুজ্জীবিত করা গিয়েছে পিথোভাইরাস সাইবেরিকাম ও মলিইউভাইরাস সাইবেরিকামকে। এরা প্রায় ৩০ হাজার বছরের প্রাচীন। এই দু’টি ভাইরাসকে পুনরুজ্জীবতকারী বিজ্ঞানী ক্লভেরি জানাচ্ছেন, এরা ফের সংক্রামক হয়ে উঠেছে। তবে এদের আক্রমণের লক্ষ্য এক কোষী অ্যামিবা। তবে গবেষক ক্লাভেরির দাবি, এই ধরনের অন্য ভাইরাসগুলি কিন্তু মানুষকে আক্রমণ করতেই পারে। তবে আশার কথা, বাইরের পরিবেশে এলে এরা কিছু ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, বরফাবৃত অঞ্চল এবং সামুদ্রিক এলাকার বাস্তুতন্ত্র যাতে কোনওভাবে বিঘ্নিত না হয় সে দিকে নজর রেখে পরিবেশ নীতি প্রণয়ন করা। তাই আগামী বসুন্ধরা দিবসের অর্ধ শতবর্ষে মানুষের অঙ্গীকার হোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে বিশ্বজাগরণের সূচনা করা।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক
আরও পড়ুন: লকডাউনে স্বস্তির সঙ্গে বন্যপ্রাণের বিপাকও