Coronavirus in India

করোনা কিন্তু হার স্বীকার করেনি

সত্যিই কঠিন পরিস্থিতি, বিশেষত যে মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে গত কয়েক মাস কেটেছে তার শেষ দেখতে আমরা উদ্গ্রীব।

Advertisement

ইন্দ্রনীল দাস ও বিকাশ সিংহ

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২১ ০১:১৫
Share:

মাস দুয়েক আগে এক তথ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে (‘পুজোর পরেই কোভিডের চুড়ো’, ১৯-১০) আমরা করোনার ভয়ঙ্কর প্রভাব কমার সময়সীমা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। মহামারির অঙ্ক (যা এসআইআর মডেল নামে পরিচিত) এবং সেরোসার্ভের তথ্য মেনেই বিজয়াদশমী ও কালীপুজোর মাঝে পশ্চিমবঙ্গে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তার পর প্রকোপ ক্রমাগত কমতে শুরু করলেও, এখনও আক্রান্তের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি।

Advertisement

জনমানসে এখন এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এক দিকে করোনার টিকা আবিষ্কার এবং দৈনিক সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হওয়াতে আমরা অনেকেই ভেবে নিয়েছি, করোনা-যুদ্ধ জয় হয়ে গিয়েছে এবং মাস্ক, হাত ধোয়া বা দূরত্ববিধির দরকার নেই। অন্য দিকে কোভিডের এন৫০১ওয়াই মিউটেশন বা করোনার নয়া স্ট্রেন বি.১.১.৭ আবার হৎকম্প ধরিয়েছে। সত্যিই কঠিন পরিস্থিতি, বিশেষত যে মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে গত কয়েক মাস কেটেছে তার শেষ দেখতে আমরা উদ্গ্রীব। সঙ্গে এটাও ভাবা উচিত, এত দিন কষ্ট করে কি শেষে তীরে এসে তরী ডুববে? সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, যত দিন না টিকা প্রয়োগ শেষ হচ্ছে মাস্ক সরানো উচিত নয়। করোনা হার স্বীকার করেনি, তারই প্রমাণ হিসেবে সে ক্রমাগত নিজের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে চলেছে।

আগের প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম যে, যদি কোনও এক অঞ্চলে এক জনের করোনা হয়েছে বলে আইসিএমআর (ভারতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান অনুসন্ধান পরিষদ)-এর কাছে তথ্য নথিভুক্ত হয়ে থাকে, তা হলে প্রকৃতপক্ষে সেই সংখ্যাটি প্রায় ৮০ বা সর্বোচ্চ ১৩০ পর্যন্ত হয়ে থাকতে পারে। তার কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত করোনা আক্রান্ত নিজের অজানতেই যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটি ছিল মে মাসের সেরোসার্ভের ফলাফল, পরবর্তী অগস্ট মাসের সেরোসার্ভে থেকে জানা যায়, এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২৬ এবং ৩২। দৈনিক করোনা পরীক্ষার বৃদ্ধিকেই এই সূচক কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে দাবি করা হয়। যদিও এই কমে যাওয়ার আরও একটি যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে করোনার বিরুদ্ধে লড়ার অ্যান্টিবডির সংখ্যা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই সেরোসার্ভের সময়ে শরীরে অ্যান্টিবডি কম থাকলে, তার শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা দ্বিতীয় বার সংক্রমণের খবর জেনেছি, তাই সব দিক থেকে ভেবে দেখলে মাস্কের বর্ম এখুনি খুলে ফেলা ঠিক নয়।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক কোভিড আক্রান্তের হার ৫ শতাংশের কমে পৌঁছে গিয়েছে এবং হু-র মে মাসের কোভিড নির্দেশিকা অনুসারে যখন এই হার ৫ শতাংশের নীচে পৌঁছে যায়, তখন করোনার জন্য আপাত ভাবে বন্ধ থাকা সংস্থাগুলি ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে খুলতে পারে। আমরা বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি যোগাযোগ মাধ্যমকে ধাপে ধাপে শুরু হতে দেখেছি, হাওড়া স্টেশনে ধুন্ধুমার কাণ্ডের পর মফস্সলের রেল যোগাযোগও এখন সক্রিয়।

ক্লাসরুম ও ল্যাবরেটরি খোলার কথা এখনও শোনা যায়নি। এত দিন এই নিয়ে আলোচনার সুযোগও ছিল না, কিন্তু এ বার যে হেতু আক্রান্তের হার ৫ শতাংশের নীচে কমে এসেছে, এই আলোচনা শুরু হতে পারে। শিশুশিক্ষা ও মধ্যশিক্ষা নাহয় বাদই দিলাম। উচ্চশিক্ষা পঠনপাঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পরিচিতদের কাছ থেকে যা জানতে পারছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে ক্ষতি অনেকটাই হয়েছে, একটা উদাহরণ দিলে হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। এখন সবই অনলাইন পরীক্ষা হচ্ছে, খাতাও জমা পড়ছে ইমেলে, এহেন পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে “...অমুক জিনিসের উদাহরণ লেখো।” উত্তরে লেখা হয়েছে “আমরা এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় বিভাগে আলোচনা করেছি যে...।” অনলাইন পরীক্ষায় বই থেকে দেখে উত্তর লেখা হবে, সেটা প্রায় মেনেই নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কী লিখব, এবং কতটা লিখব, সেটাই অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে অস্পষ্ট রয়ে যাচ্ছে। এমন উত্তরপত্র কি আগেও জমা পড়ত না? হয়তো ছিল, কিন্তু এখন এমন খাতাই বেশি জমা পড়ছে।

তবে এই অধঃপতনের জন্য মূল দায় সম্ভবত করোনা এবং আমাদের পোড়া দেশের, সত্যি হয়তো সব ছাত্রছাত্রীর কাছে ফোন নেই, ফোন থাকলে নেটওয়ার্ক দুর্বল। এই ব্যাপারে অনেকেই একমত হবেন যে, করোনার প্রকোপে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্তের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা। অনেক পরিচিত শিক্ষকশিক্ষিকারা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, বই দিয়েছেন বা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন এবং এটি আমাদের জানা উচ্চ ও মধ্যশিক্ষা দুই পর্যায়েই ঘটেছে। দুই শিক্ষাবর্ষের মাঝের সময়ে ভারত করোনাতে আক্রান্ত হয়েছে, তাই ক্ষতিটা এখনও খুব প্রকট নয়, কিন্তু একটা পূর্ণ শিক্ষাবর্ষের শুধু অনলাইন ক্লাস হলে কী সুদূরপ্রসারী লোকসান হতে পারে, সেটা আমাদের সম্পূর্ণ অজানা।

এই একটু আগেই মাস্ক ব্যবহার, দূরত্ববিধির কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে আবার নিয়মিত উচ্চশিক্ষা ক্লাসরুম পঠনপাঠনের প্রশ্ন উঠছে কেন, এই দুটো কি এক সঙ্গে সম্ভব? আমরা তো সব কাজ, লোকাচার, বাঙালির প্রিয় পার্বণগুলি মাস্ক পরেই পালন করে চলেছি, তা হলে এ বার বাকিগুলোর জন্য আলোচনা হোক। সব দিক বিচারের পর নির্ধারিত হোক মাস্ক পরে উচ্চশিক্ষা ক্লাসরুম পঠনপাঠন এ বার শুরু করা যায় কি না এবং তার পর ধাপে ধাপে হয়তো মধ্যশিক্ষা? বাবা-মায়েরা হয়তো চাইবেন শিশুশিক্ষা অনলাইনেই চলুক যত দিন না টিকাকরণ সমাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু আক্রান্তের হার যে হেতু কম, প্রথমে উচ্চশিক্ষা ও ক্রমে হয়তো মধ্যশিক্ষার ক্লাসরুম খোলার আলোচনা করা যায়, সপ্তাহের সব দিন না হলেও কিছু দিন খোলা যেতে পারে।

প্রাক্তন রামানুজন ফেলো, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স; প্রাক্তন অধিকর্তা সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement